তৃষ্ণাতুর-২০২৪ (Volume-4) Published in February 2024
সম্পাদকীয় পরিষদ
সম্পাদকঃ
মুহাম্মদ ইউনুছ উদ্দিন (মামুন)
সহযোগী সম্পাদকঃ
মোঃ আলমগীর হোসেন
মোঃ আরমান হোসেন
সহকারী সম্পাদকঃ
শেখ ফাহিম ফয়সাল সৌরভ
আনিকা তাবাসসুম ওহী
আতিকা আফিয়া ব্রতী
সাহিত্য সংকলন/
তৃষ্ণাতুর
প্রকাশনায়
নির্মল বাংলাদেশ
প্রচ্ছেদ ডিজাইন ও ফর্মেটিং
মোঃ আলমগীর হোসেন
সংখ্যা
৪র্থ সংকলন
ISBN
৯৭৮-৯৮৪-৩৫-৯০৯২-৩
গ্রন্থস্বত্ব
নির্মল বাংলাদেশ কর্তৃক সংরক্ষিত
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২৪, বাংলাদেশ
শুভেচ্ছা মূল্যঃ ৩৫০ টাকা (5 USD)
যোগাযোগঃ ৩০, সড়ক-১৪, উত্তরা-১২, ঢাকা-১২৩০।
মোবাইলঃ ০১৭৫৭-৪২৪০৩৫
ওয়েব সাইটঃ https://nirmol-bangladesh.org
ইমেইলঃ contact@nirmol-bangladesh.org
উৎসর্গ
নির্মল বাংলাদেশের সকল ত্যাগি ও নিবেদীত কার্যনির্বাহী সদস্যদের শ্রদ্ধ্যেয় ও সম্মানীত পিতা ও মাতাকে তৃষ্ণাতুর এর ৪র্থ সংকলটি উৎসর্গ করা হলো।
প্রিয় পাঠক
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নির্মল বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত “তৃষ্ণাতুর” নামে এই সাহিত্য সংকলনটি প্রকাশ কর হয় । মাতৃভাষা উপলক্ষে হাজারো সংকলনের মধ্যে আমাদের এই সংকলনটি ভাষাকে উপলব্ধি করার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে সমর্থন জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় ১৯১টি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের ৬৫ তম অধিবেশনের আলোকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে আজ আপনি একটি চাকুরীর জন্য গেলে প্রথম দেখবে ইংরেজি ভাষাকে কতটুকু জব্দ করতে পেরেছে? পরস্পর কথা বলতে ইংরেজি ব্যবহার করতে পারে কিনা? অথচ আমাদের অনুধাবন করা উচিত মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া ও মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কোনো ভাষা ভালোভাবে শেখা যায় না। মাতৃভাষা মানুষের একান্ত আপন। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার সেরা দান। মানুষ যদি তার মাতৃভাষাকে যথাযথ সম্মান ও মূল্যায়ন না করতে পারে তাকে চিরদিন অন্ধকারে ডুবে থাকতে হয়। মাতৃভাষার মর্যাদা জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক। যারা মাতৃভাষার মর্যদা দেয় না তারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিশ্বাস করে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, মাতৃভাষাকে পেছনে পেলে দেশ বা রাষ্ট্র এগোতে পারে না। তাই সমাজের দরিদ্রতা, বৈষম্য, নিরক্ষরতা দূর করে মাতৃভাষা বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটানো আবশ্যক। আর আমার প্রথম গল্পে চায়নাদের কথা একটু চিন্তা করুন, তারা তাদের ভাষাকে কতটা আপন করে নিয়েছে, তারা মনে প্রানে বিশ্বাস করে তাদের ভাষাটাই তাদের প্রাণ, এমনকি তাদের ভাষা দিয়েই তারা বিশ্বজয় করেছে।
আজ চীনারা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে বিদেশী ভাষা ব্যবহার করতে হয় না, বিদেশীদের তাবেদারি করতে হয় না, বিদেশি সংস্কৃতি লালন করতে হয় না। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও আজও নিজেরা মাতৃভাষাকে সঠিকভাবে লালন করতে পারিনা। এটির জন্য আমাদের দেশের সিস্টেম সবচেয়ে বড় দায়ী। এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে আমাদের তরুণদেরকেই পরিবর্তনের স্লোগানে উৎসাহী হতে হবে। কারণ আমরা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারিনি। ভাষার কারণে এত প্রাণের বিসর্জনের পরেও মাতৃভাষা বাংলা নিজ দেশে যেন অনেকটা উপেক্ষিত! ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা আর ভাষাকে সমৃদ্ধ করা এক নয়। তাই বলে ইংরেজি চর্চা বর্জন করতে হবে তা কিন্তু নয়; বরং ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রেও ইংরেজি জানা বেশি প্রয়োজন। ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা যেন ২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক না হয়। সুতরাং মাতৃভাষা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নিতে হবে আজ।
মুহাম্মদ ইউনুছ উদ্দিন (মামুন)
সম্পাদক, তৃষ্ণাতুর
প্রিয় পাঠক,
২০১৭ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে নির্মল বাংলাদেশ একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও সামাজিক সংগঠন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০২৪ সালে তৃষ্ণাতুরের ৪র্থ সংখ্যা প্রকাশ আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতারই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননশীলতার প্রকাশে তৃষ্ণাতুর সংকলনের অবদান অসামান্য। বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা, আধুনিকতা, নান্দনিকতা ও সৃজনশীলতাকে ধারণ ও লালনের মাধ্যমে মননশীল মেধা ও মহৎ কর্ম স্পৃহা নিয়ে নির্মল বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবেই আমার বিশ্বাস।
বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি এবং নতুন প্রতিভার বিকাশে তৃষ্ণাতুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তৃষ্ণাতুরের মাধ্যমে আমরা তরুণ লেখকদের লেখনীকে সমৃদ্ধ করতে এবং তাদের ভাবনা-চিন্তাকে প্রকাশের সুযোগ করে দিতে চাই। এবারের তৃষ্ণাতুরে আমরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা আকর্ষণীয় ও চিন্তা-উদ্দীপক রচনা পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি এই রচনাগুলো পাঠকদের মনোরঞ্জন ও জ্ঞান দান করবে।
নির্মল বাংলাদেশের সকল আয়োজনে যারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। নির্মল বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময়, চলুন একসাথে পথ চলি।
পরিশেষে নির্মল বাংলাদেশ সংগঠনটি জ্ঞানপিপাসুদের কেন্দ্র হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশা এবং তৃষ্ণাতুর এর সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
মোঃ আলমগীর হোসেন
নির্বাহী পরিচালক ও সভাপতি
নির্মল বাংলাদেশ
প্রিয় পাঠক,
“তৃষ্ণাতুর” সাহিত্য সংকলনটি চর্তুর্থ বারের মতো প্রকাশিত হওয়ায় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান তরুন লেখকদেরকে অভিনন্দন এবং এই কষ্ট সাধ্য কর্মযজ্ঞটি সফলতা সাথে সম্পাদনের জন্য নির্মল বাংলাদেশকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
মানব সভ্যতা বিনির্মাণে রয়েছে অজস্র মানব-মানবীর অসামান্য অবদান ও আত্মত্যাগ। এরূপ আত্মত্যাগের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সংগঠন। তেমনি একটি সংগঠন হচ্ছে “নির্মল বাংলাদেশ”। নির্মল বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ, সুবিধাবঞ্চিত শিশু, বেকারত্ব হ্রাস, শিক্ষা, গবেষণা, জনসচেতনতা এবং এসব সমস্যা নিরসনে, দেশের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের অন্যান্য সকল কাজের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সংরক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন, প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ রোধ, শিক্ষা ও গবেষণা ধর্মী প্রশিক্ষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
“তৃষ্ণাতুর” নির্মল বাংলাদেশের একটি ধারাবাহিক সাহিত্য সংকলন যা নতুন লেখক এবং পাঠকদের মনে জ্ঞানার্জনের স্পৃহা বহুগুণে বৃদ্ধি করবে বলে আশা করছি। নির্মল বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময় চলুন একসাথে পথ চলি। পরিশেষে নির্মল বাংলাদেশের দীর্ঘায়ু, উজ্জ্বল ভবিষ্যত এবং তৃষ্ণাতুর এর সার্বিক সফলতা কামনা করছি।
ড. মারিয়া জামান
সহকারী অধ্যাপক
চেয়ারম্যান, মেরিন ফিসারিজ এন্ড একোয়াকালচার বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়
আসসালামু-আলাইকুম,
তৃষ্ণাতুর সাহিত্য সংকলনটি চর্তুর্থবারের মতো প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগ নেওয়ায় নির্মল বাংলাদেশ এবং এর সকল স্বেচ্ছাসেবীদেরকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নির্মল বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত “তৃষ্ণাতুর” সাময়িকীতে সকল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত। ইতোমধ্যে নির্মল বাংলাদেশের এই উদ্যোগটি দেশের লেখক সমাজের মাঝে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়েছে বিধায় বহু সৃজনশীল লেখকদের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে তৃষ্ণাতুর প্রকাশনাটি।
অপর দিকে নির্মল বাংলাদেশ আর্তমানবতা ও দেশের স্বার্থে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করে আসছে তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে গ্রামীন জনগোষ্ঠীর, পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, কোমলমতি দরিদ্র শিক্ষার্থীসহ সবাইকে দেশের মূলধারায় যুক্ত করার মহৎ কাজকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের শিক্ষা গবেষণা ও সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্মল বাংলাদেশের “তৃষ্ণাতুর” সাময়িকীটি তরুণ পাঠকদের মনে জ্ঞানার্জনের স্পৃহা বহুগুনে বৃদ্ধি করবে বলে আমি আশা রাখি। বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার জন্য সকলকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অবশেষে নির্মল বাংলাদেশের সকল কার্যক্রম দেশের স্বার্থে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি এবং নির্মল বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত এবং তৃষ্ণাতুর এর সার্বিক সাফল্য কামনা করি।
ড. মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান
অধ্যাপক
চেয়ারম্যান, মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিয় পাঠক,
নির্মল বাংলাদেশ ২০১৭ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে হাঁটিহাঁটি পায়ে একটি সম্পূর্ণ অলাভজনক ও সামাজিক সংগঠন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০২০ সাল থেকে শুরু করে চতুর্থবারের মত “তৃষ্ণাতুর’ ৪র্থ সংখ্যা প্রকাশ তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতারই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননশীলতার প্রকাশে তৃষ্ণাতুর সংকলনের অবদান অসামান্য।
বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা, আধুনিকতা, নান্দনিকতা ও সৃজনশীলতাকে ধারণ ও লালনের মাধ্যমে মননশীল মেধা ও মহৎ কর্ম স্পৃহা নিয়ে নির্মল বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবেই আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (Fourth Industrial Revolution) এর সাথে তাল মিলাতে ও দেশকে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হলে বিজ্ঞান গবেষণা ত্বরান্বিত করার কোনো বিকল্প নাই। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত মেধাবী শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞান চর্চাই এর মূল নিয়ামক। এক্ষেত্রে নির্মল বাংলাদেশ কর্তৃক সংকলিত তৃষ্ণাতুর এ প্রকাশিত সকল লেখাসমূহ মানুষের মাঝে আবেদন সৃষ্টির মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।
“তৃষ্ণাতুর” নির্মল বাংলাদেশের একটি ধারাবাহিক প্রকাশনা, যা নতুন লেখক এবং পাঠকদের মনে জ্ঞানার্জনের স্পৃহা বহুগুণে বৃদ্ধি করবে বলে আশা করছি। নির্মল বাংলাদেশের সকল আয়োজনে যারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। নির্মল বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময় চলুন একসাথে পথ চলি। পরিশেষে নির্মল বাংলাদেশের দীর্ঘায়ু, উজ্জ্বল ভবিষ্যত এবং তৃষ্ণাতুর এর সার্বিক সফলতা কামনা করছি।
নির্মল বাংলাদেশ সংগঠনটি জ্ঞানপিপাসুদের কেন্দ্র হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশা এবং সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
মোহাম্মদ সাহেদ মাহাবুব চৌধুরী
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
বিশ্ব ব্যাংক
Poems – কবিতা
মরুর আকুতি
উম্মে হাবীবা
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মরেছি আমি, ভয়াল ঘা-এ,
বিষাক্ত যেন প্রাণের স্পন্দন,
লাভা উদ্গীরিত হবে এক্ষুণি
প্রতিটি কোষে, শিরা-উপশিরায়।
উপঢৌকনের দুঃখ-ব্যাথা সইতে নারি-
তব কেন হেরিতে চাই মায়াবি ঐ মুখখানি।
দিবা-নিশীথে কত মৃত প্রাণের দোলা লাগে মরুচিত্তে,
কভু আসিয়া লওনি খোঁজ,
হৃদ্-মাঝারে উপেক্ষিত গোঙানি;
হায়! ভুলিলে কেমনে?
আমার আকাশ বিষাদ-প্রায়, জমা ধূলিতে অর্ধমৃত!
নিদ্রালু হাওয়ার ঘর্ষণ লাগিতে লাগিতে খসে গেছে সজীব আত্মা।
স্তব্ধ হওয়া, করুণ এ সুর দোলাতে চাই প্রণয়ের প্রতীক্ষায়।
আজ আমার দিন নয়
নুসরাত মেহজাবীন মুমু
ধানমন্ডি দিবা শাখা, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ
হয়তো আজ আমার দিন নয়,
তাই বলে কী মন খারাপ করলে হয়?
আসবে আমারও দিন;
উঠব হয়ে রঙিন,
রাঙাবো এই ধারা নিজের মতো করে,
সেই আকাঙ্ক্ষায় আছি বহুদিন ধরে।
করব আমি বিশ্বজয়,
তাই তো আমার নেই কোনো ভয়।
স্বপ্ন আমার বিস্তৃত,
যা আছে হৃদয়ে নিঃসৃত।
স্বপ্ন দেখতে নেই কোনো বাঁধা,
জীবনটাই তো গোলকধাঁধা;
জিতে যাব যেদিন,
সেদিন আমায় আর কে পায়?
তাই,
হয়তো আজ আমার দিন নয়,
তাই বলে কী মন খারাপ করলে হয়?
মুক্তির সিঁড়ি
তৌফিকুল ইসলাম আশিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
মুক্তির সেই লাল সিঁড়ি বেয়ে,
লাল পতাকা দেখানো উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো ধেয়ে,
আর রণাঙ্গনের বিদ্রোহী গান গেয়ে,
বহুবার নেমেছি মনে মনে।
চিৎকার করে বলেছি আমি- তোরা চোর চোর চোর।
তোরা মানুষের মন ভেঙ্গেছিস, ধোকা দিয়েছিস
তবু কাটেনি তোদের ঘোর,
আসেনি সমাজের পাখি ডাকা এক ভোর।
আমি আর আমরা, আটকে গেছি স্বার্থের জাঁতাকলে
অন্ধ, পিচাষদের কথার জালে
জানি বাকরুদ্ধ আমি, বিক্রি করেছি সততা স্বার্থের কাছে
নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছি তাও যতটুকু বাকি আছে।
আমি জানি রক্ত টগবগ করে, ইচ্ছে তোদের পশুদের খুন করে,
নতুন বাংলা আনবি তোরা, কিন্তু প্রথমেই পা ভেঙে দেয় ওরা।
ভাবি আমার পরিবার, আমার স্বজন
ভাবি না, ফুলে ফেঁপে উঠছে শুধুই সমাজের পিচাষ গুটি কজন।
সততার মৃত্যু নেই, শুধু ধরে বেঁধে রাখে কেউ
ভাঙতে হবে শিকল তোদের,
লাল সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে,
ভুঁড়ি ফাটিয়ে দিতে হবে, অর্থ আর হিংসা দিয়ে যারা গড়েছে ওদের।
দেখ সূর্য উঠেছে, নিহিত সততা তুলে ধরেছিস,
সেলাই করা মুখ খুলতে শিখেছিস,
আর পরাজয় আসবে না এই মনের
অধিকার পাবে সবাই, তবেই বাংলা সকল জনের।
মুজিবের অবদান
¬সারাজিন স্বীকৃতি
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
মুহাম্মদ আলী জিন্নার একটি ঘোষণা,
বাঙালিদের জন্য যেটি ন্যায্য হলোনা।
বলতে হবে উর্দু সবাইকে-
আমাদের বাঙালিদের ঠেকায় কে?
মুজিব বোঝায় হায়রে,
বাংলা আমাদের ভাষা নয়, বাংলা আমাদের মা,
কথাটি শুনে শিউরে ওঠে সবার গা।
যেদিন ছাত্রলীগের মুজিব আন্দোলন করলো,
সেদিন মুজিব গ্রেফতার হলো।
হে ভাষা শহীদ, ১৯৫২ সালে
তোমাদের বিনিময়ে ফিরে পেয়েছি বাংলা আমরা,
সবার মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তোমরা।
১৯৬৬ সালে মুজিব ছয় দফা করলো দাবি,
কারণ, বাঙালিদের শোষণ করেই যাচ্ছিলো
ভীতু পাকিস্তানি।
ওরা ছয় দফা দাবি মানলোনা,
মুজিব মনের জোড় হারালোনা।
এসে গেলো ১৯৭০ সন,
মুজিব জিতলো ইলেকশন।
পাকিস্তানিরা মুজিবকে ক্ষমতা দিলোনা,
মুজিবও থেমে রইলনা।
১৯৭১ সালে মুজিব ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলো,
পাকিস্তানিরা ২৫শে মার্চ রাতে আক্রমণ করলো।
মুজিব পাঠিয়ে দিলো তার শেষ বার্তা,
“আজ থেকে স্বাধীন আমরা।”
৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ঝড়ে দেশ পাক হানাদার মুক্ত হলো,
নয় মাস যুদ্ধ শেষে মুজিব ছাড়া পেয়ে স্বাধীন দেশে ফিরলো।
এসে গেলো ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সেই ভয়াবহ রাত,
মুজিবের স্বপরিবারে হত্যার পেছনে বাঙালিদেরই হাত।
যে মুজিব দেশের জন্য এত কিছু করলো,
অবশেষে নিজ লোকদের হাতেই হত্যা হলো।
দানবেরা ছোট্ট শিশু রাসেলকেও ছাড়লোনা,
সেই রাতে কেও বাঁচতে পারলোনা।
তাই আজও বাঙালিরা স্মরণ করে দিনগুলিকে,
উদযাপন করে বুকে গর্ব ও শ্রদ্ধা রেখে।
মুজিব আমাদের জাতির পিতা,
চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে যথা।
তাঁকে তো ভোলা যায়না,
মন যে মানতে চায়না।
হ য ব র ল জীবন
আব্দুল্লাহ সরকার সবুজ
বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ
চলছে চারিদিকে যেন সার্কাস
বিভ্রান্ত ভন্ডুলের দিন আজ
বহুরূপী মানুষের মিথ্যে অভিনয়
যে দিকে তাকাই মনে হয় ছলনার জয়
নতুন নতুন নিয়ম আর যাতনা
এ যেন আজব কারখানা!
চারদিকে চলছে নানান বাহানা
কতজন দেয় মিথ্যে সান্তনা,
কেউ কারো কথা শুনিতে নাহি চায়
এভাবেই তো দিন আসে যায়।
মনে হয় যেন আজ সবাই নেতা
বলে যায় কতসব নীতিকথা,
কথাগুলো যদি হতো দেশ ও দশের পক্ষে
গর্বিত হতাম আজ মানুষ হিসেবে।
নিয়মের বাইরে চলছে যেন সব
ছড়িয়ে পড়েছে মিথ্যে কলরব
সত্যকে চাপা দেয়ার চেষ্টায় অবিরত
মিথ্যের কাছে অনেকেই করে মাথা নত।
অন্যায় জুলুম আর অত্যাচার
সুদিন একদিন আসবে সবার
এই হ য ব র ল জীবন থেকে মোরা চাই মুক্তি
প্রয়োজনে উদয় হোক সবার শুভবুদ্ধি।
আত্মগত মানচিত্র
মোসা: ইসরাত জাহান
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
চিত্ত আভায় মত্ত প্রভা সন্ধানে লীন কৃত্য
নয়ন অলখে পলক সমুখে সাঁঝের আদিত্য।
পূর্ণতাকে শূন্যে মেলায়; শূন্য থেকে পূর্ণ,
হৃদসাগরের মানসপটে ঢেউ তুলে যায় অকপটে-
অনিন্দ্য দেশ অনন্য মা
পুলক মোহাচ্ছন্ন।
আন্দোলিত সুশীল জড়ো পুষ্পরাজির ছায়া
উষ্ণ হিমে স্রোতস্বিনী ছড়িয়ে রাখে মায়া।
শিকলবাঁধা আবদ্ধতা-স্বাধীনতার শুদ্ধতা
স্বপ্ন লেখে মুক্তি
উচ্ছ্বাসিত শক্তি সেথা মিথ্যে অত্যুক্তি।
সূক্ষ্ণ তুলির আঁচড় মাখা রঙিন রঙে ছবি আঁকা,
নিভৃত নয় বিলোল বিভোর উল্লাসে কল্লোল
সুবাসিত সহাস্য বিজয় হিল্লোল।
দগ্ধ রণে ক্ষুব্ধ পণে
বিরহ-প্রেমের স্বগত প্রলাপ
স্বচ্ছ প্রকাশ অন্তরালে বহ্নিশিখা ঠেকায় প্রতাপ।
অগণিত আত্মা বহায় লোহূ পাথার বারি
পরাভূত জীবন আকাশ, সুপ্ত আশা-দীর্ঘশ্বাস
বিশ্ব বুকে লাল-সবুজে ছন্দ তোলে তারই।
আত্মত্যাগের বিজয় নিশান উড়তে থাকুক পৃথিবী জুড়ে
বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশ গৌরবের অহঙ্কারে
শতক কিংবা যুগান্তরে
ঐশ্বর্যের অলঙ্কারে।
বর্ষার দিন
আসফিয়া আল মালালা
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ
বর্ষার দিনে বৃষ্টি এলো,
আকাশটা যেন কেমন হলো।
এই দিনেতে মাদল বাজে,
আকাশেতে বাদল সাজে।
বৃষ্টি যখন গুঁড়িগুঁড়ি,
হেঁটে চলি ছাতা ধরি।
এই দিনেতে ফোঁটে কদম,
বজ্রপাত হয় থমথম।
বৃষ্টি পড়ে টাপুস টুপুস,
খিচুরি খাই গাপুস গুপুস।
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে,
রিমঝিম বাদলা নামে।
ফুল পাখি আর গাছপালা যে,
এই দিনেতে মেতে উঠে।
এই দিনে যে নতুন করে
সবার খুশি জেগে ওঠে।
প্রিয় বাংলা
তাহরীম ইবনে শামীম
নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল এন্ড কলেজ
বাংলা আমার প্রাণ,
বাংলায় গাই গান,
বাংলা যে মোর লক্ষ্য
শহীদ ভায়ের আত্মদান।
একাত্তরের দিনগুলি,
কভু নাকো মোরা ভুলি,
আজো অক্ষত আছে
বাঙালির গায়ে ছোড়া গুলি।
অজস্র খুন রাজপথে,
লিখা আছে সব খতে,
কে বা ভুলতে পারে তা?
ভুলতে পারে মনোরথে?
বিজয়ের সেই দিন,
হলো বাংলা স্বাধীন,
ত্রিশ লক্ষ বাঙালির
রক্তদান হলো না বিলীন!
কে বা আছে কোনখানে?
ভুলবে সব স্বার্থের টানে,
তারা না এলে দুনিয়ায়
বাঙালিরা বাঁচত আন প্রাণে।
কিষাণ, জেলে, ছাত্র
ভেদ ভুলে দিবারাত্র,
বাংলার তরে দিল প্রাণ
বলি, দিল বলি সর্বগাত্র।
সেই বলিদান,
জাগ্রত করে বাঙালি প্রাণ,
তা রোধে গুলি ছোড়ে
হানাদার সেই পাষাণ।
রণ্ডা হলো কত নারী,
অনাথ শিশুর সেই আহাজারি,
আজো বাঙালিরা কাঁদে
ফেলে আপনার অশ্রুবারি।
নিজ পরিবার তেয়াগী,
আপনার দেশের লাগি,
প্রাণ হারাল কত জনে
কত বাঙালি কত বিবাগী।
শহীদ ভাইদের রক্ত,
বৃথা যাবে না কোনো অক্ত,
দৃপ্ত পায়ে হাঁটবে বাঙালি
হবে আরো শক্ত।
প্রিয় বাংলায় বাঁচি,
তাদেরে মোরা আজো যাচি,
তাদের তরেই হলাম যে
মোরা, হলাম আজি সব্যসাচী!
পথশিশু
নুর দ্বীপ কুমার বিপুল চন্দ্র রায়,
দিনাজপুর সরকারি কলেজ
কেউ নেই এই দুনিয়ায়,
দেখিনি মা তোকে,
খুব কষ্টে বেঁচে আছি,
পথ-শিশু হয়ে।
ভাগ্য-হীন জন্ম আমার,
এই জগৎ মাঝে,
অনাহারে রাত্রি কাঁটাই,
নিদ্রা-হীন চোখে।
অভাগারে দান করিতে,
মন সবার বাঁধে,
নষ্ট খাবার দিচ্ছে ফেলে,
ময়লা ডাস্টবিনে।
মানুষ হয়ে চায়না বুঝিতে,
করে দূর ব্যবহার,
ভাগারে গিয়ে খেতে হয়,
নোংরা পচা খাবার।
স্বয়ম্বরা
মুবিন তাজ শশী
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
পরম মোহিত পললপূর্ণ এ ছন্দে,
বঙ্গবীণা সুর ছড়ায় চিত্ত স্কন্দে;
এ সুর ঢেউ খেলে যায় মাতৃসরিৎ-তটে,
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ধলেশ্বরী বয়ে,
রাখালের বাঁশি-বাউলের একতার লয়ে-
মেঠোপথ ধরে, বাংলার বুক জুড়ে;
শ্রমার্জিত সোনার ফসলের হাসি ফুটিয়ে,
নভঃ বুকে মুক্ত পাখির স্বপ্ন ছড়িয়ে!
হিন্দু-মুসলমান একত্রে এক গানে
বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে আপন মেনে,
এ সুর নৃত্য করে ‘সাংগ্রাই’ প্রমোদে;
আর্য-চর্যাপদ-প্রাকৃত স্মরণ করে,
গুপ্ত-সেন-পাল-মোগল শাসন হয়ে
শাসিত বাংলা-উপনিবেশ ছেড়ে,
পরাধীন বাংলার দুঃস্বপ্নকে ঘিরে।
এ সুর ছড়ায় ‘নকশিকাঁথার মাঠ’-এ,
কবি দাশের ‘রূপসী বাংলা’-র প্রাতে-
এ সুর চলে প্রীতি-সাম্যের গান গেয়ে,
নৃত্যরতা রমণীর রৌপ্য নুপূর ছুঁয়ে!
এ সুরে ভাসে- কালরাতের চিৎকার,
মায়ের-বোনের বুকভাঙ্গা হাহাকার,
বাবার স্বজনহারা রিক্ততা;
এ সুর বঙ্গন্ধুর বাণী শোনে
ভাই বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে আসে।
এ সুরে বাংলা বিশ্বের বুকে শির সমুন্নত করে,
অন্যায়-দারিদ্র্য-ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়ে;
এ সুরে বাংলা নব দিগন্তে পদ বাড়ায়
বাঙালির বোনা স্বপ্নের কিরণ হয়ে;
এ সুরে বাঙালি পুনরায় ওঠে জেগে,
‘সোনার বাংলা’ পত্তনের প্রত্যয় নিয়ে।
ভাষা সংগ্রাম
জান্নাতুল মাওয়া ওয়াফা
স্কুলএজ
যে ভাষাতে ভাই শুধু বলে যাই
লিখি ও সাহিত্যে,
ভুলিব কিভাবে তারই সৃষ্টি, যা
মিশে আছে অস্তিত্বে।
মুখের ভাষার সাম্য সমতা
সহজ হয়নি পেতে,
প্রানের এ ভাষা পাওয়ার জন্য, বহু
জীবন হয়েছে দিতে।
পৃথিবী জুড়ে ইতিহাস হয়ে
এনেছি মাতৃভাষা,
বেঁচে থাকবে কেয়ামত তরী
এটাই মোদের আশা।
হৃদয় ভরিয়া প্রার্থনা করি
হে প্রভু, জান্নাত কর দান,
রফিক, শফিক, জব্বার শহীদের
সম্মান অফুরান।
প্রহর
খান নূর ই লাবিবা সাফা
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির এক একটি প্রহর,
আজও স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁদের সংগ্রাম ও
আত্ম-অঙ্গীকারের কথা।
যাঁরা রাজপথ রঞ্জিত করে ভেঙেছিল প্রথা,
তাঁদেরই জন্য আমরা আজ পেয়েছি
চিরা-কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
পটের বিবির পটে আঁকা, বর্নিল
দূরান্তের স্বপ্নে আঁকা, রঙিন
সোনার বাংলা, তোমার পিতা।
শিমুল মালা
মোঃ আরমান হোসেন
নির্মল বাংলাদেশ
শীতের প্রথম আলো ঝরে,
গ্রামের মেঠো পথে ধরে,
শিমুলের ফুল মালায় পোহালো,
সুন্দরী বালিকার রঙিন হাসি নিয়ে।
প্রিয় প্রেমিকা, তুমি আমার অদৃশ্য আলো,
শীতের শুরুতে মোর মন উদাসী।
শীতের প্রথম বাতাসে তোমার হাসি,
মোর মনে আনে রঙিন স্বপ্নের কাহিনী।
শিমুল ফুলের মালা পরালে,
তুমি স্বর্গের প্রিয়মন্থর লাগে।
প্রিয় প্রেমিকা, তুমি আমার প্রভাত,
সুখের স্বপ্ন মোর অবাক হাসির স্রোত।
গ্রামের মেঠো পথে তোমার পায়ের ছায়া,
জীবনের সকল দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।
শীতের শুভ্র সকালে তোমার আগমন,
মোর জীবনে এনে দেয় সজীব্ প্রাণ।
তুমি আমার শিমুলের ফুল মালা,
আমি তোমার প্রেমে মগ্ন মালায় হাসি ভরা।
প্রিয় প্রেমিকা, তুমি আমার সবসময়,
শীতের শুভ্র সকালে আমার জীবনের স্বপ্ন হও।
বসন্ত
মোঃ আলমগীর হোসেন
নির্মল বাংলাদেশ
আজি বসন্ত এসেছে ধরায়,
হবে গো মিলন তোমাতে আমায়।
আজি প্রভাতে বাসন্তী সাজেঁ সেজো গো তুমি,
দেখিবে আপন ভূবন,গাহিবে তোমার স্তুতি।
আজি এ ফাল্গুনে এসেছে বসন্ত,ডাকিছে তোমায়,
জানি তুমি দেবে সাড়া,মম গলে তুমি পড়াবে মালা।
আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে,কত পাখি গায় গান,
তাইতো তোমাতে চেয়েছি আমি কনঁকচাপার ঘ্রাণ।
আজি ফাল্গুনে নব বসন্তের প্রভাত বেলায়,
মম মন প্রাণ বেকুল তোমাকে দেখায় নেশায়।
আজি এ ঋতু রাজ বসন্তের প্রভাত বেলায়,
এনেছি কুড়িয়ে পলাশ, কৃষ্ণচূড়া বাধঁবো তোমার খোঁপায়।
অন্যান্য
বিভীষণ
কাজী ফারজানা আতিকা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
প্রচণ্ড বর্ষণের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল শ্রাবণের। বর্ষণটা শ্রাবণ ধারার নয়, বরং গুলির! এখনো এই আওয়াজটায় কেনো যেনো অভ্যস্ত হতে পারেনি সে। লে. কমান্ডার শ্রাবণ মাহমুদ। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনাকারী দলের একজন সদস্য। বয়স বেশি না।খুব অল্প সময়েই সকলের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে সে।
আড়মোড়া ভেঙে বুটটা পড়ে বাইরে বের হলো শ্রাবণ। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আক্রমণ করেছে। তা দমাতে ব্যস্ত পাক সেনারা। “দমে যাবে ছেলেরা” বলেই হনহন করে গিয়ে ঢুকে পরল তাদের পরিকল্পনার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায়। সবার মুখ থমথমে! সেই সময়েই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো এক সৈনিক। পিছু হটেছে মুক্তিবাহিনী। তবে ধরতে পারেনি কাউকে। মনে হলো যেন ভবিষ্যতবাণী করেছিল শ্রাবণ!
শুরু হলো নতুন পরিকল্পনা। যে করেই হোক ধ্বংস করতে হবে এদের আস্তানা। ভয় ঢুকে গেছে মনে। সরাসরি তাদের ক্যাম্পেই হামলা হলো আজ! এমনেই বর্ষার শুরু থেকেই মুক্তিবাহিনীর দাপট বেড়েছে। যেখানে সেখানে জীপ উড়িয়ে দিচ্ছে। হামলা করছে যখন তখন। অথচ তারা কিছুই করতে পারছে না। তিনদিন আগে অস্ত্রসহ সাহায্য এসেছিল বেসক্যাম্প থেকে। কিন্তু সেটাও ধ্বংস করে দিল পুরো ব্রিজসহ। সাহায্য পাওয়ার রাস্তাও বন্ধ সেই থেকে। একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তারা। “এতো তাড়াতাড়ি খবর পায় কিভাবে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা?”
সেদিন প্রশ্নটা করেছিল শ্রাবণ এই ঘরেই। বোম ফাটার মতো চমকে উঠেছিল সবাই। সেই থেকে সবার মনেই সবাইকে নিয়ে সন্দেহ। আজ তার রেশ ভালোভাবেই লক্ষনীয়। সবাই কথা বলছে মেপে মেপে। সারাদিন অস্থিরতায় কেটে গেল তাদের। গভীর রাত। সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এমনকি পাহারাতেও নেই কেউ আজ। শুধু নিজ ঘরে পায়চারি করছে শ্রাবণ মাহমুদ। খাকি উর্দি পোশাক গুলো ব্যাগে নিয়ে তৈরি সে। অপেক্ষা করছে কারো!
১২ দিন পর। কুমিল্লা সেনানিবাস। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেসক্যাম্প।
মেজর আজিজ আহমেদ এর সামনে বসে আছে চাঁদপুর ক্যাম্পের লেঃ কমান্ডার শ্রাবণ মাহমুদ। সেই রাতে ক্যাম্পটা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে যায়। সবাইকে হত্যা করা হয়। বেঁচে যায় শুধু শ্রাবণ আর তার কিছু সঙ্গী। তারা খবর পেয়েছিল পাশের গ্রামে নাকি মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এসেছিল। অনুসন্ধান করেও কিছু না পেয়ে ফিরে আসছিল তারা। ক্যাম্পের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় আগুনের ধোঁয়া উড়ছে। তারপরও তারা চেষ্টা করেছিল ক্যাম্পে পৌঁছানোর। তবে মুক্তিবাহিনী ঘিরে রেখেছিল। তাই তারা কোনোরকমে পালিয়ে এসেছে। এখন তাদেরকে যশোর ক্যাম্পে বদলি করে পাঠানো হবে।
নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য মিলিটারি জীপে উঠে বসেছে খাকি উর্দি পোশাকে লেঃ কমান্ডার শ্রাবণ মাহমুদ, সৈনিক মনোয়ার হোসেন (মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জু), সৈনিক আলতাব আলী (মুক্তিযোদ্ধা সাজু), সৈনিক গোলাম মোস্তফা (মুক্তিযোদ্ধা সুলতান), সৈনিক সেলিম খান (মুক্তিযোদ্ধা বুলু), সৈনিক তোফাজ্জল ইসলাম (মুক্তিযোদ্ধা রশিদ)!
এক পথশিশুর ঈদ
সাদিয়া আফরিন প্রমা
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক
দিনের শেষে রাত আর রাতের শেষে দিন। এভাবেই প্রতি রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চিরচেনা সেই ঢাকা শহরটি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠে, কোলাহলে মেতে উঠে পুরো শহর। এই কোলাহলে প্রতিদিনের মতো আজও ঘুম ভাঙে জরির। ঘুমটা নিজ থেকে ভাঙেনি। ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে ওর অসুস্থ মা। জরি অবশ্য ঘুমাতে খুবই ভালোবাসে। কেননা ঘুম ভাঙলেই ওর ক্ষিদের জ্বালাটা তীব্র হয়ে ওঠে যা ওর জন্য খুবই কষ্টদায়ক।
বয়স কতো হবে জরির? সাত বা আট। তবে এই বয়সে অন্যান্য শিশুর মতো পুষ্টিকর খাদ্য, ভালো পোশাক, খেলনা কিছুই সে পায়না। এসব কিনে দেয়ার সামর্থ্য তার মায়ের নেই। যদিও এ দায়িত্বটা বাবার উপর থাকে। কিন্তু জরির পৃথিবীর পুরোটা জুড়ে শুধু ওর মা। জরিরও কিন্তু ভালো একটা পরিবার ছিল। জরির বাবা একটি চাকরি করতো। স্বল্প আয়ে তাদের সংসার খুব ভালই চলছিলো। কিন্তু জরির বয়স যখন ৩ বছর, তখন তার বাবা তাদের রেখে চলে যায়। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য জরিকে নিয়ে পথে নামে তার মা। সেই ৩ বছরের জরিই আজ ৭ বছর বয়সি হয়ে গেছে। এখন জরি তার মাকে নিয়ে এই ঢাকাতেই কোনো এক ফুটপাতে রাতে মাথা গোজার ঠাই করে নিয়েছে।
বেলা বেড়ে যাচ্ছে, জরিকে এখনই একটি বস্তা নিয়ে বের হতে হবে, যদিও বস্তাটা তার তুলনায় বড়। ঘুরবে এই রাস্তা থেকে ওই রাস্তা,এই ডাস্টবিন থেকে ওই ডাস্টবিন। আমাদের শহরের প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হয় “টোকাই”….
আজ ২৫ তম রোজা, জরি ৬ টি রোজা রেখেছিল। অনেক কষ্ট হয়েছিল তার। সেহেরির সময় একটা শুকনো রুটির অর্ধেকটা ও খায় আর বাকিটুকু ওর মা। বাকি ক্ষিধাটুকু সে কল থেকে পানি খেয়েই মিটিয়ে নেয়। তারপর ইফতারির সময় শুধু পানি, আর মাঝেমাঝে ভাগ্যে জোটে একটি রুটি। বেশী কষ্ট হয় বলে ওর মা ওকে বাকি রোজা গুলো রাখতে দেয় নি।
রাস্তায় হাটতে হাটতে হঠাৎই একটি বড় শপিংমল এর দিকে জরির চোখ পড়ে। খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে। ভেতরে নানান রঙের কাপড় সাজানো। জরি ভেতরে যাওয়ার সাহস পায়না, ময়লা কাপড়ে দেখলে যদি তাকে মেরে তাড়িয়ে দেয়। তবে সে নিয়ে জরির কোনো দুঃখ নেই। কাধে ঝোলানো বস্তাটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতে থাকে, ‘‘আচ্ছা ওগুলো বিক্রি করলে ২০ টাকা পাবো তা দিয়ে কি আমার জন্য একটা জামা কেনা যাবে?
নাহ্ থাক, আমার জন্য না মায়ের জন্য একটা শাড়ী কিনতে পারলে…’’
হঠাৎই কারো চিৎকার এ জরির ভাবনায় ছেদ পড়ে। পেছনে তাকাতেই দেখে এক সাহেব তাকে বলছে…
-এই টোকাই এর বাচ্চা এখানে কি? যা এখান থেকে।
লোকটা ওকে তেড়ে মারতেও আসে কিন্তু গায়ে ময়লা কাপড় থাকায় জরি মার খাওয়া থেকে বেঁচে যায়। সে মাথা নিচু করে হাটতে থাকে। গন্তব্য সেই ফুটপাত, মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে সে।
ফুটপাতে ফিরে মায়ের কাছে টাকাটা দিয়েই কংক্রিটের তৈরী ফুটপাতে একটি পুরনো ছেড়া কাথা বিছিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পরে সে। চোখে ঘুম আর তার মাঝে বিরাজমান হাজারো স্বপ্ন। স্বপ্নে সে মায়ের সাথে ভেসে বেরায় পুরো শহর। বাস্তবে অসম্ভব বিষয়গুলোই স্বপ্নে সম্ভব হয়ে ধরা দেয় ওর কাছে। হঠাৎই শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। হ্যা আর কিছু নয়, তার মা তাকে ডাকছে, সকাল হয়ে গেছে। আবার জীবনযুদ্ধে নামতে হবে এই ক্ষুদে যোদ্ধাকে।
এমনি করেই এক একটা দিন শেষ হয় যায় জরির। মায়ের মুখে শুনেছে আগামীকাল নাকি ঈদ। রাস্তায় বের হয়ে জরি দেখে সবাই শেষ মুহূর্তে ঈদের কেনাকাটা করতে ব্যস্ত। এসব দেখতে দেখতে জরির মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিকেলে জরি মার্কেট থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাস দেখতে থাকে। তার অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ কাধে হাতের স্পর্শ পেয়ে জরি চমকে উঠে। পেছনে তাকিয়ে দেখে এক ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
পিছনে ফিরতেই ছেলেটি জিজ্ঞাসা করে….
- কিরে নিবি? অমন একটা জামা।
জরি- কে কিন্না দিবো?? আমার তো কেউ এ নাই মা ছাড়া।
ছেলেটি- আয় আমার সাথে।
ছেলেটি জরিকে নিয়ে মার্কেট এ ঢোকে। সেখানকারই একটি দোকান থেকে লাল টুকটুকে একটি জামা কিনে দেয় জরিকে। জরি বুঝতে পারে না সে কি সপ্ন দেখছে নাকি সত্যি ই……
ছেলেটার ডাকে ঘোর কাটে তার। জরির হাতে ৩০০ টাকা দিয়ে বলে এই নে, তোর মাকে বলবি আগামিকাল সেমাই রান্না করতে। বলেই ছেলেটি চলে যায়। জরি একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ছেলেটির চলে যাওয়া দেখে। ছেলেটি চোখের আড়াল হতেই জরি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকে, অনেক অনেক খুশি সে।
দৌড়াতে দৌড়াতে ওরা যে ফুটপাতে রাতে ঘুমায় সেটার অনেকটা কাছে চলে আসে জরি, এখানেই তো ওর মা বসে থাকে। হয়তো ওর মা ওকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে দেখে একটু অবাক হবে, তাতে কি? সে আজ অনেক খুশি।
হ্যা জরি পৌছে গেছে প্রায়। রাস্তা পাড় হওয়ার জন্য রাস্তায় নামে সে। রাস্তার ওপাশ থেকে জরির মা ও তাকিয়ে আছে জরির দিকে। কিন্তু আজকে তার চাহনিটা একটু অন্যরকম। যেনো অজানা এক আশংকায় ছেয়ে গেছে তার মন। হঠাৎই জরির মায়ের চোখদুটো অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে যায়। জরি বুঝতে পারেনা কি হয়েছে, কেনই বা তার মা এভাবে তাকিয়ে আছে। কারণ খোজার চেষ্টা করে সে। তবে তার আগেই ছোট্ট জরির গলা চিড়ে বেরিয়ে আসে চিৎকার।
জরির মা অসুস্থ শরীর নিয়েই “জরিইইইইই” বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসে। জরি রক্ত মাখা শরীরটা রাস্তায় পড়ে আছে,হাতে সেই ৩০০ টাকা আর রক্ত মাখা লাল জামাটি।
হ্যাঁ,একটু আগেই একটি মালবাহী ট্রাক জরিকে ধাক্কা দেয়। জরির রোগা শরীরটা ছিটকে গিয়ে আছড়ে পড়ে রাস্তার উপড়। ট্রাকটি শুধু জরিকেই নয় বরং তার নতুন কাপড় পড়ে ঈদ করার স্বপ্নটাকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। আর এভাবেই ভেঙে যায় এক পথশিশুর স্বপ্ন…………
অনন্ত প্রতীক্ষা
মাতৃকা আরজমীর
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে সবেমাত্র বিছানায় শুয়ে চোখটা একটু বুজেছি, এমন সময় আচমকা ফোনের রিংটোন শুনে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। আননোন নাম্বার।
ফোনটা রিসিভ করে বললাম, “হ্যালো, কে বলছেন?”
অপর পাশ থেকে উত্তর এলো, “হ্যালো, আরিফ ভাই, আমি আলিফ। এটা ফরিদা ফুফুর নাম্বার। আমার মোবাইলে চার্জ নেই। সুইচ অফ হয়ে গেছে। তাই ফুফুর মোবাইল থেকে ফোন দিলাম।”
আমি বললাম, “আচ্ছা, সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এই ভরদুপুরে ফোন দিয়ে আমার কাঁচা ঘুমটা নষ্ট করার কারণটা কি জানতে পারি?”
“ভাইজান, সর্বনাশ হয়ে গেছে! আম্মা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। এখন আম্মা হাসপাতালে, তবে এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ফুফু বললেন, আম্মা নাকি বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। হাঁচি-কাশি আর হালকা জ্বরের সাথে প্রচুর শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আমরা দুশ্চিন্তা করব বলে আম্মা আমাদের এত দিন কিছু জানতে দেননি। গতকাল গ্রামে এসে আম্মার মুখ দেখেই বুঝেছিলাম আম্মা গুরুতর অসুস্থ। আজ ভোরে বিছানা থেকে উঠতেই হঠাৎ করে মাটিতে পড়ে যান।”
আমি আঁতকে উঠলাম। আমার খুবই সুস্থ-সবল একজন মানুষ। তাঁকে দেখলে বোঝার কোনো উপায়ই নেই যে র তাঁর বয়স ৭০ এর বেশি।
আমি আলিফকে বললাম, “তুই চিন্তা করিস না। আমি এখনই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে। আম্মা শিগগিরই সুস্থ হয়ে যাবেন।”
ছোট ভাইকে সান্ত্বনা দিতে কথাগুলো বললাম ঠিকই, কিন্তু মনের মধ্যে কেন জানি না এক অজানা আতঙ্ক জেঁকে বসল।
আমি বাড়ির সবাইকে দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে বললাম। তারপর ঘরে এসে প্রয়োজনীয় মালপত্র আর জামা-কাপড় গোছাতে শুরু করলাম।
আমার স্ত্রী শাহিদা এসে বলল, “তুমি রেডি হও। আমি এসব দেখছি।”
সব গোছগাছ শাহিদার ভরসায় রেখে আমি জামা-কাপড় পরতে চললাম। দুপুর দুইটা বাজার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রওনা দিয়ে দিলাম। গন্তব্য কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ।
আমি আরিফ ইসলাম, সরকারি চাকরিজীবী। আমার স্ত্রী শাহিদা আক্তারও সরকারি চাকরি করে। বড় ছেলে ইরফান ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে আর ছোট মেয়ে আফরা ক্লাস টেনে পড়ে। আমার জন্ম ১৯৬৯ সালে। ছোট ভাই আলিফের জন্ম ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। আলিফ ঢাকা শহরের বিখ্যাত উকিল। তার দুই ছেলে। আমাদের বাবা আতাহার ইসলাম ১৯৭১ সালে যুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি ছেড়েছিলেন, আর ফেরেননি। ছোট থেকে আম্মাই আমাদের বড় করেছেন।
আজ ১৩ই ডিসেম্বর, বুধবার। পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্য আমি আর শাহিদা ছুটি নিয়েছিলাম। আগামী তিন দিন তো এমনিতেই সরকারি ছুটি। গাড়ি চলতে শুরু করার পর আমরা সবাই বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। এমন সময় আফরা হঠাৎ বলে উঠল,
“বাবা, কাল তো শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। একটা আর্ট কম্পিটিশন হওয়ার কথা। আমি তো তাহলে পার্টিসিপেটই করতে পারব না।”
আমি বললাম, “একটা আর্ট কম্পিটিশনে অংশ না নিতে পারলে কী এমন হবে? কম্পিটিশনটা আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যটা যদি তুই বুঝতে পারিস সেটাই অনেক।”
“একদম ঠিক বলেছ।” আমার কথায় সায় দিলো শাহিদা। বলল, “১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আমার আব্বাকেও তারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অমানবিক অত্যাচার করেছিল তাঁর ওপর। শেষ পর্যন্ত তারা আব্বাকে মেরে ফেলে। এরপর থেকে সরকারের দেওয়া ভাতা আর আব্বার রেখে যাওয়া সামান্য সম্পত্তি দিয়ে অভাব অনটনের মধ্যে আম্মা অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছেন। আম্মা সবসময় চাইতেন আমি যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, একটা ভালো চাকরি করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি তাঁর কষ্টের ফসল দেখে যেতে পারেননি। আমি কলেজে থাকতেই আম্মা মারা যান।”
শাহিদার চোখ ছলছল করে উঠল। ইরফান আর আফরা দুপাশ থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল। লক্ষ করলাম শাহিদার চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
এরপর আর গাড়িতে তেমন কথা হলো না। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকায় রাত আটটার সময় বাড়িতে পৌঁছলাম। বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলাম ছোট চাচা ইকরাম ইসলামকে। চাচাকে সালাম দিয়ে আম্মার কথা জিজ্ঞেস করলাম। চাচা জানালেন আম্মার অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমি আর বিশ্রাম নিতে পারলাম না। গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আলিফকে ফোন করে হাসপাতালের সামনে দাঁড়াতে বললাম।
হাসপাতালে সামনে পৌঁছতে না পৌঁছতেই আলিফ ছুটে এলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে বললাম, “আলিফ, আম্মার কী খবর? এখন কেমন আছেন?”
আলিফ কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। দৌড়ে হাসপাতালের ভেতরে চলে আসলাম।
রিসিপশনে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “বেগম সুফিয়া খাতুন কোন ওয়ার্ডে আছেন?”
ততক্ষণে আলিফ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই আলিফ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “চলো, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। ভাইজান, আম্মার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তার সাহেব বলেছেন,” আরিফের গলা ভারী হয়ে গেছে। কথাটা বলতে গিয়ে আটকে গেল। বুঝতে পারলাম কোনো খারাপ সংবাদ আছে। নিজের মনকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলাম। এরপর আলিফের দুই হাত চেপে ধরলাম। প্রশ্ন করলাম, “ডাক্তার সাহেব কী বলেছেন?”
আলিফ কোনোমতে বলল, “আম্মার খুব বিরল একটা রোগ ধরা পড়েছে। বিদেশেও এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তিনি আর তিন দিনের বেশি বাঁচবেন না।”
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আমার মাথা কাজ করছে না। এই কয়েক মাস আগে যখন বাড়িতে এসেছিলাম, কী হাসিখুশিই না ছিলেন আম্মা! হঠাৎ করে কীভাবে একটা মানুষের শরীরের এত অবনতি হতে পারে?
আলিফ আর কান্না চেপে রাখতে পারল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল সে। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। আমার চোখ দুটোও ঝাপসা হয়ে এলো। ভেবে পেলাম না এখন আমাদের কী করণীয়।
দুজনে আম্মার ওয়ার্ডের সামনের একটা সিটে এসে বসলাম। এমন সময় একজন ডাক্তার এসে বললেন, “আলিফ সাহেব একটু শুনবেন?”
আলিফ উঠে গিয়ে তাঁর সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। ডাক্তার সাহেব চলে গেলে ও আমার পাশে এসে বসল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বললেন ডাক্তার সাহেব?”
আলিফ বলল, “ডাক্তার সাহেব বললেন আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে। এই দুর্দিনে আশা হারিয়ে ফেললে তার পরিণতি খুব ভয়ানক হতে পারে। আম্মা জানেন যে তিনি আর হয়তো তিনদিনের বেশি বাঁচবেন না। কিন্তু আম্মা যদি এখন বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলেন তাহলে হয়তো তাঁকে সর্বোচ্চ আর একদিন বাঁচানো সম্ভব হবে। বেঁচে থাকার ইচ্ছাই এখন আম্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আর আমরা যদি এখন ভেঙে পড়ি, তাহলে আম্মার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই তো মরে যাবে। আমাদের এখন শক্ত থাকতে হবে ভাইয়া। আম্মাকে কোনোমতেই আশা হারাতে দেওয়া যাবে না।”
আমি সব শুনে বললাম, “ডাক্তার সাহেব ভুল কিছু বলেননি। শোন, আমরা এখন থেকে আম্মার সামনে খুব হাসিখুশি থাকব। আম্মাকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে দেবো না। ঠিক আছে?”
আলিফ আমার কথায় সম্মতি জানাল। এরপর আমরা দুজনে আম্মার সাথে দেখা করতে গেলাম। আম্মা আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন।
বললেন, “আরিফ, বাবা আমার! এতদিন কোথায় ছিলি? এই বুড়িটাকে তো ভুলেই গেছিস।”
আমি আম্মার পা ছুঁয়ে সালাম করে বললাম, “আম্মা, এসব কী বলছেন বলুন তো! সন্তান কীভাবে নিজের মাকে ভুলতে পারে?”
আম্মা বললেন, “সে তো বটেই। আচ্ছা, আমার নাতি-নাতনিরা কেমন আছে? কতদিন দেখি না ওদের। ওরা এসেছে তো তোর সঙ্গে? আর বড় বৌমা কেমন আছে?”
“ওরা সবাই ভালো আছে। কিন্তু ওরা খুব ক্লান্ত, তাই ওদের বাড়িতে রেখে এসেছি। কাল ভোরে ওদের নিয়ে আসব না হয়,” বললাম আমি।
বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ আম্মার সাথে গল্প করলাম। আলিফ এর স্ত্রী সন্তানদের খবরও নেয়া হলো। কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম ডাক্তারের করা সে ভয়ানক ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। শুধু আমি নই, আম্মা আর আলিফও যেন মনের অজান্তেই ভুলে গেছে সেই কথা। সত্যিই তো! এত হাসি-খুশি, প্রাণ চঞ্চল একটা মানুষ কীভাবে এত কম দিন বাঁচতে পারে এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু ঐ দুঃসংবাদটার কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠলাম। খুবই বিচলিত হয়ে পড়লাম আমি।
আম্মা সেটা বুঝতে পেরে বললেন, “বাবা রে, তোরা আমার সন্তান, আমার গর্ব। জানি, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না। কিন্তু সেই নিয়ে যদি তোরা দুশ্চিন্তা করিস, আমি যে তাহলে শান্তিতে মরতে পারব না। আর ডাক্তার সাহেব আমায় বলেছেন মনের ভেতর আশা ধরে রাখতে। এখন তোরাই যদি ভেঙে পড়িস, আমি কীভাবে বাঁচব বল তো?”
আমি বললাম, “আম্মা, দয়া করে এমন কথা বলবেন না।”
আম্মা বললেন, “আচ্ছা, বেশ। বলব না। কিন্তু তোরা আমাকে একটা কথা দিবি?”
আমি আর আলিফ জিজ্ঞেস করলাম, “কী কথা আম্মা?”
আম্মা জবাবে বললেন, “১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন মুজিব ভাই তাঁর সেই রক্ত গরম করা ভাষণ দেন তখন তোদের আব্বা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে সময় আলিফ আমার পেটে। তোদের আব্বা যাওয়ার আগে আমায় বলেছিলেন, ‘‘সুফিয়া চিন্তা করো না। আমার কিচ্ছু হবে না। ইনশাআল্লাহ, একদিন এই দেশকে স্বাধীন করে ঘরে ফিরব।’’ তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসবেন। আমিও কথা দিয়েছিলাম তার জন্য আমি অপেক্ষা করব। তারপর নয় মাস কেটে গেল। যুদ্ধ শেষ হলো। স্বাধীন দেশে আলিফ জন্ম নিল। কিন্তু তোদের আব্বা আর এলেন না। অনেকে বলেছিল তিনি শহিদ হয়েছেন। তাহলে তো তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু না, সেটা পাওয়া যায়নি। আমি জানি, তোদের আব্বা বেঁচে আছেন। দেখিস তোরা, একদিন তিনি ঠিক ফিরে আসবেন। বাবারা, আমাকে কথা দে। আমি যদি মরে যাই তাহলে তোদের আব্বা যখন ফিরে আসবেন তখন তোরা তাঁকে বলবি যে তোদের আম্মা তার কথা রেখেছিল। মরার আগ পর্যন্ত সে তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছিল।
আম্মা কাঁদতে লাগলেন। আলিফের চোখ দুটোও ছলছল করছে। ছোটবেলা থেকে আম্মা আমাদের অনেক গর্ব করে বলতেন, ‘‘এদেশ স্বাধীন হয়েছে তোদের আব্বার জন্য। উনি ফিরে এলে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করবি।’’ আমরা সবসময় ভাবতাম আব্বা হয়তো কোনো একদিন ফিরে আসবেন। দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু আব্বা আর ফেরেননি। তখন মনে হতো, হয়তো অন্যদের কথাই ঠিক, আব্বা শহিদ হয়েছেন। তবে আম্মা কখনোই সে-কথা বিশ্বাস করতেন না। তাই আমরা দুই মা-ভক্ত ছেলেও নিজেদের মায়ের কথাকেই বেদবাক্য হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। ধরে নিয়েছিলাম আব্বা একদিন ফিরবেন। কিন্তু আমাদের এই কল্পনা কল্পনাই রয়ে গেল। আব্বা এলেন না।
আমি আম্মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আলিফও আমাদের জড়িয়ে ধরল। রাতটা হাসপাতালেই কাটালাম। পরদিন ভোরবেলা উঠে ফজরের নামাজ পড়ে গাড়ি নিয়ে আমি আর আলিফ বাড়ি ফিরলাম। দুঃসংবাদটা শোনার পর কেউই বিশ্বাস করতে চাইছিল না। কিন্তু নিয়তির কাছে সবাই অসহায়। সবাইকে মানসিকভাবে শক্ত হতে বললাম। যদিও জানি না আমি নিজে কতটা শক্ত থাকতে পারব। সকাল সাতটা বাজার আগেই সবাইকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছলাম। টের পেলাম, কারোর মনের অবস্থাই ভালো না। ভালো না থাকাটাই অবশ্য স্বাভাবিক। আমার মাথায় শুধু একটা বিষয় ঘুরছে, আজকের পর আর মাত্র দুটো দিন। এরপরই ভাগ্যের নির্মম লিখনকে মেনে নিতে হবে আমাদের। আর কিচ্ছু করার থাকবে না।
ইরফান, আফরা আর আলিফের দুই ছেলে লাবিব আর তামিম একসাথে আম্মার ওয়ার্ডে গেল তাঁর সাথে দেখা করতে। লাবিব ইরফানের সমবয়সী আর তামিম পড়ে ক্লাস এইটে। আমি আর আলিফ দরজার সামনে পায়চারি করছি। শাহিদা আর তার ছোট জা ফাহমিদা সামনের সিটটাতে বসে আছে। আজ শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শাহিদার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। সকাল থেকেই খেয়াল করছিলাম শাহিদা বেশ খানিকটা অন্যমনস্ক। আমরা যখন আম্মার ব্যাপারে ঐ দুঃসংবাদটা দিলাম তখন থেকে ও প্রচণ্ড মুষড়ে পড়েছে।
শাহিদার বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাই ঢাকা শহরের বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন। শুনেছি ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানিরা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর তারা একটা খুঁটিতে বেঁধে তাঁকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বলে। তিনি রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানিরা তাঁর উপর নৃশংস অত্যাচার চালায়। তারপরও ওরা যখন তাঁকে দিয়ে ঐ কথা বলাতে ব্যর্থ হয় তখন তারা শাহিদার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। শাহিদা পরের বছর জানুয়ারি মাসে জন্ম নিয়েছিল। পরম আদরে তাকে বড় করেছিলেন তার মা। কিন্তু শাহিদা কলেজে থাকাকালীন তিনি মারা যান। তাই বিয়ের পর আমার মাকে পেয়ে শাহিদা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গিয়েছিল। নিজের মায়ের মতো ভালবাসতে শুরু করে আম্মাকে। তাদের সম্পর্কটা শাশুড়ি-বৌমা থেকে দ্রুত মা-মেয়ের সম্পর্কে পরিণত হয়।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে যখন পায়চারি করছি এমন সময় ওয়ার্ডের ভেতর থেকে আফরার গলা শুনতে পেলাম, “দাদু শোনো, আমি বলছি, তোমার কিচ্ছু হবে না। ডাক্তার আঙ্কেল এমনিই ওসব কথা বলেছেন।”
আম্মা মুচকি হেসে বললেন, “জানি তো সোনা। আমাকে তো বেঁচে থাকতেই হবে। নাহলে তোরা কাকে দাদু বলে ডাকবি বল তো?”
“হ্যাঁ, সেটাই তো। আর তুমি না থাকলে আমাদের ভূতের গল্পই বা কে শোনাবে?” বলল তামিম।
বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ তাদের কথোপকথন চলল। বাচ্চারা বের হওয়ার পর আমরা বড়রা চারজন ভেতরে ঢুকলাম। আম্মাকে আমরা পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। আম্মা কে কেমন আছে, সেই খোঁজখবর নিলেন। এরপর বললেন, “বড় বৌমা, আজ তো ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ। তোমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। বাড়িতে যাবে না?”
“না, মা,” জবাব দিলো শাহিদা। বলল, “ঐ বাড়িতে তো আমার মা-বাবা কেউই নেই। এখানে তো অন্তত মা বলে ডাকার একজন আছে।”
“তা তো বটেই,” আম্মা বললেন। “তবে বৌমা, তোমার আব্বা কিন্তু তোমার গর্ব। এই দেশকে তিনি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন। তা না হলে কী করে একটা মানুষ শত অত্যাচারের মুখেও পাকিস্তানিদের জয়গান করা থেকে বিরত থাকে? নিজের জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি নিজের মাতৃভূমির প্রতি অনুগত ছিলেন। এমন দেশপ্রেমী এদেশে কতজনই বা আছে?”
শাহিদার মুখ দেখে বুঝলাম এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার মনের ভেতর। গর্ব ও শ্রদ্ধার সাথে খানিকটা কষ্ট আর অভিমানের মিশেলে তৈরি বিচিত্র এক অনুভূতি!
বাকিটা দিন এত দ্রুত কীভাবে কেটে গেল বলতে পারব না। তবে প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, আর মাত্র দুই দিন! রাত আটটার দিকে আম্মাকে ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালের ক্যান্টিনে নিয়ে এলাম। অল্প সময়ের মধ্যে বাচ্চাদের নিয়ে ফরিদা ফুফুও চলে এলেন। ততক্ষণে ইকরাম চাচাও হাসপাতালে চলে এসেছেন। এতদিন পর সবাই এক টেবিলে বসে খেতে খুব ভালো লাগল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অনেকক্ষণ ধরে আমরা গল্পগুজব করলাম। দেখতে দেখতে আরও একটা দিন চলে গেল।
ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ, শুক্রবার। দুপুরে আমরা ছেলেরা একসাথে মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে আম্মার জন্য অনেকক্ষণ দোয়া করলাম। হাসপাতালে ফিরে জানতে পারলাম আম্মার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। হাত-পা নাড়াতে পারছেন না। হতবাক হয়ে গেলাম আমি। আম্মার ওয়ার্ডে ঢুকে দেখলাম আম্মা শুয়ে আছেন।
আম্মা আমাকে দেখেই বললেন, “আরিফ বাবা, আমি তো আর বেশি দিন বাঁচব না। তবে বিশ্বাস কর, আমার কোনো আক্ষেপ নেই। তোদের দুজনকে আমি মানুষ করতে পেরেছি, এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে! কিন্তু তোর আব্বাকে যদি এই মৃত্যুশয্যায় শেষবারের মতো দেখে যেতে পারতাম তাহলে হয়তো মনে শান্তি নিয়ে মরতে পারতাম। তবে ডাক্তারবাবুর কথামতো আমি যদি কাল মারা যাই, তাহলে নিজের মনে অন্তত একটা সান্ত্বনা পাব যে, আমি বিজয় দিবসে মরেছি; এদেশের বিজয়ের দিন মরেছি; তোর আব্বার বিজয়ের দিন আমি মরেছি। আমার আর কীসের আফসোস?”
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। আম্মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। সেদিন অনেক মুরব্বি, হুজুররা হাসপাতালে এসে পবিত্র কোরআন শরীফ পড়ে আম্মার জন্য দোয়া করলেন। গ্রামের অনেকে এসে আম্মার সাথে দেখা করে গেলেন। মনে মনে ভাবছি, তবে কি সত্যিই আম্মা আর একদিন বাঁচবেন?
সেদিন রাতে কোনোভাবেই ঘুমাতে পারলাম না। সারারাত নামাজ আর দোয়া-দরুদ পড়ে কান্নাকাটি করলাম। শেষ রাতে যখন চোখটা হালকা একটু লেগে এসেছিল এমন সময় ফজরের আজান কানে এলো। সাথে সাথে উঠে বসলাম আমি। তড়িঘড়ি করে ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি আম্মা উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন।
তাঁকে সালাম করে জিজ্ঞেস করলাম, “আম্মা শরীরটা কেমন লাগছে?”
আম্মা উত্তর দিলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো লাগছে বাবা।”
“হাত-পা নাড়াতে পারছেন এখন?” প্রশ্ন করলাম আমি।
“নাহ, হাতে-পায়ে গতকাল থেকে যে কী হলো, পুরো অবশ হয়ে গেছে,” আম্মা বললেন।
আমি বললাম, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। ডাক্তার সাহেব আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলবেন।”
আম্মা মৃদু হেসে বললেন, “মরেই তো যাব। এখন আর আমার হাত-পা নাড়িয়ে কাজ কী?”
আম্মার হাসিমুখটা দেখে হঠাৎ এক অজানা বিয়োগ-ব্যথায় আমার অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। মনে হলো আম্মাকে কি আজকের পর আর কখনো হাসতে দেখব?
আমি সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। ফজরের নামাজ পড়ে সবাই মিলে আমাকে দেখতে গেলাম। আত্মীয়-স্বজনরা সবাই এসেছেন তাঁকে দেখতে। আম্মা খুব শান্তভাবে কথা বলছেন। কিন্তু তাঁর চোখে এক অদ্ভুত অস্থিরতা লক্ষ করলাম।
এমন সময় একটা মহিলা কণ্ঠ হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে উঠল, “ভাবি তো আতাহার ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদটা আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করলেন না।”
কণ্ঠটা অনুসরণ করে ভিড়ের মাঝে তাকাতেই চোখ পড়ল জেবা চাচির উপর। তিনি ইকরাম চাচার স্ত্রী।
আম্মা উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আরিফের আব্বা মরেন নাই! তার মৃত্যুর কী প্রমাণ আছে?”
বেশ কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। তারপর আবার মানুষের গুঞ্জনে পুরো ওয়ার্ডটা ভরে উঠল।
আম্মা একটা সময় বললেন, “আরিফের আব্বা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। নিজের দেশের জন্য তিনি সব করতে রাজি ছিলেন। তিনিই আমাকে এই দেশ, এদেশের মানুষকে নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছেন, তাদের ভালবাসতে শিখিয়েছেন। তিনি সবসময় বলতেন, “আমার সন্তানরা একদিন এই দেশের মানুষের জন্য কাজ করবে।” আমি তাকে নিয়ে সবসময় গর্ব করতাম, আজও করি।”
জেবা চাচির মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। কিছুক্ষণ পর আমরা প্রায় সবাই যখন সকালের নাশতা করতে বাইরে এসেছি তখন হঠাৎ আম্মার চিৎকার শুনে দৌড়ে ভেতরে আসলাম। বিছানার কাছে এসে নিচু হয়ে দেখতে পেলাম আম্মার চোখ দুটো বিস্ফারিত। মুখটা খানিকটা খোলা। একটা হাত বুকের ওপর।
আমার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে গেছে। গলা থেকে একটা আওয়াজও বের হচ্ছে না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ইয়া আল্লাহ! নিয়তির কাছে এভাবে হেরে গেলাম আমরা! এই সমগ্র বিশ্বে আম্মাই একমাত্র মানুষ ছিলেন যাঁকে সারা জীবন নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেছি, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি। কিন্তু এর বিনিময়ে কখনো ঠকতে হয়নি। ছোট থেকে সবসময় আম্মা আলিফ আর আমাকে আমাদের বাবার আদর্শ মেনে চলতে বলতেন। আমি সরকারি চাকরিটা পাওয়ার পর আম্মা খুব খুশি হয়েছিলেন। আম্মা সবসময় চাইতেন আমরা দুই ভাই যেন সারাজীবন দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করি।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠল ‘ইন্নালিল্লাহ’ ধ্বনিতে। কান্নার রোল পড়ে গেল চারদিকে। আমার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। ঐ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে আমি ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এলাম।
কখনো ভাবিনি, যে মানুষটা আমাদের জন্য এত কিছু করল সেই মানুষটাই একদিন এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আম্মা আব্বাকে অনেক ভালবাসতেন, নিজের থেকেও বেশি। তাই সম্ভবত আল্লাহ তাঁর মৃত্যুটা এই দিনেই লিখেছিলেন। কিন্তু আব্বা? তিনি আজও কেন ফিরলেন না? জানি না। কোনোদিন ফিরবেন কিনা তাও জানি না। হয়তো আম্মার কথা অনুযায়ী একদিন তিনি ফিরবেন।
অলিখিত সুখ
আহমেদ রাকিবুল ইসলাম
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। মৃদু বৃষ্টি যাকে বলে। আকাশের ভীষণ মন খারাপ। যেনো সে জোর করে নিজের কান্না থামিয়ে রাখতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছেনা। ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মৃদু এই বৃষ্টির উৎপত্তি। আদন, আকাশের এই পরিণতিতে নিজে অনেকটা চিন্তিত। আদন এই বৃষ্টিকে নিজের কল্পনায় উপভোগ করার চেষ্টা করছে। কল্পনায় সে এক পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে প্রকৃতির গাছপালা আর আকাশের রঙ মিলে ফ্যাকাশে সবুজ রঙ ধারণ করে। পাহাড়ের এক ধার থেকে নিচে তাকালে মেঘের আস্তরণ দেখা যায়। মৃদু এই বৃষ্টিতে একটা কোমল বাতাস বইছে। বৃষ্টির ফোটা তার চোখে পড়ে অশ্রুসিক্ত হচ্ছে যা মুখ গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। একটা মানুষ সারাজীবন অরফানেজ এর মতো বদ্ধ কারাগারেও থেকে যে প্রকৃতির এমন রুপ অনুভব করতে পারে তার নিদর্শন আদন নিজেই।
বিকালের এই সময়টায় প্রতিদিনই আদন নিয়ম করে ৩ তলার করিডোরে এসে দাঁড়িয়ে বাহিরের পার্কের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই এতিমখানাটা বেশ বড়, পাশেই একটা সুন্দর পার্ক আছে। বিকালে পার্কে অনেক পিতামাতাদের দেখা যায় তাদের সন্তানদের নিয়ে আসতে। আদন দেখতে পায় একটা মহিলা তার ছোট্ট শিশুটিকে হাটানো শিখাচ্ছেন। দক্ষিনের সাইড রোডে একজন লোক তার ছেলেকে সাইকেল চালানো শেখাচ্ছে। ছেলেটা বার বার সাইকেল থেকে পড়ে যাচ্ছে আর তার বাবা তাকে ধরে ফেলছে।
আজকের দিনটা আদনের জন্য ভালো না, কারণ বৃষ্টির জন্য পার্ক জনমানবশূন্য! কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তার প্রতিদিন বিকালের প্রিয় মুহুর্তটা বৃষ্টি নষ্ট করে দিয়েছে। পার্কে আজ কেউ নেই! বাবা-মায়ের অভাবটাকে এই জায়গায় এসে আদন খুব উপভোগ করে। উপভোগ এই জন্য যে নিজে এই স্নেহ না পেলেও তার কাছে এই বাবা-মায়ের স্নেহ এমন জিনিস, যা দেখতেও সুন্দর!
৪ তলা এই অরফানেজের দুই তালায় আদনের রুম। একটি রুমে মোট ৬ জন আলাদা বিছানা নিয়ে থাকে। এই এতিমখানার মধ্যে বিশেষ খেলার মাঠ আছে। বিনোদনের জন্য সচারচর এতিমখানার শিশুদেরকে বাহিরে নিয়ে যাওয়া হয়না। বাহিরের দুনিয়া থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন একটা পরিবেশ। আদন মাঝে মাঝে দেখে ৬-৭ বছরের অনাথ শিশুদের এখানে নিয়ে আসা হলে প্রথম ক্ষেত্রে এই শিশুগুলো কতোটা কষ্টে ভোগে। আদন এইদিক থেকে অনেক খুশি যে তার মানষিক বিকাশ ঘটার আগেই তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এমন সময়টাতে তাকে এই জীবণ বরণ করতে হয়েছে যখন অসহায়ত্ব ধারণ করার কষ্ট তার মাথা পেতে নিতে হয়নি।
আদনের বয়স এখন ১২ বছরের কিছুট কম। একদম ছোট বয়স থেকে সে এই এতিমখানায় বড় হয়েছে। তার বাবা মা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু তার নিজস্ব একটা কল্পনার জগৎ আছে। সেখানে তার মা প্রতিদিন নিজ হাতে আদনকে খাইয়ে দেয়। বিশেষ দিনগুলোতে আদন তার বাবা মায়ের সাথে অরফানেজ এর পাশের পার্কে হাটতে বের হয়। এমন আরো অনেক কিছু!
আদন ছোটবেলা থেকে এখানে বড় হলেও তার বিশেষ কোনো বন্ধু নেই। তার সাথে অন্যান্য বাচ্চারা বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও আদন বেশ চুপচাপ প্রকৃতির একটা ছেলে। ছোটবেলা থেকে তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা অরফানেজ এর লাইব্রেরি আর করিডরের ছোট জায়গা, যেখান থেকে সে বাহিরের দুনিয়ার সাথে কিঞ্চিৎ যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করে।
আদন অনেক বই পড়তে পছন্দ করে। প্রতিটি গল্পে পরিবার, প্রেম, ভালোবাসার মতো ব্যাপারগুলো তার মধ্যে তীব্র চাহিদার তৈরি করে। যা সে প্রতিনিয়ত কল্পনার জগতে পূরণ করে। আদনের ভীষণ শখ ট্রাভেলিং করার। এডভ্যাঞ্চারাস বই থেকে সে বিভিন্ন রকমের সমুদ্র, পাহাড়, মরুভূমি, তুষার মেরু সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে। সে নিজে নিজে কল্পনার রাজ্যে ডুবে থাকে যেখানে সে কখনো পাহাড়ে বৃষ্টিতে ভিজে, আবার কখনো সমুদ্র স্নান করে, কখনো আবার খটখটে মরুভূমিতে উটের পিঠে অচিনদেশের পাড়ি জমায়, কখনো তুষারপাতে মেরু অঞ্চলে স্নো-ম্যান বানায়। মাঝে মাঝে সে ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠে তার মায়ের সম্পর্কে জানার জন্য। সে ভাবতে শুরু করে তার মা হয়তো আছে পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে। তখন আবার মনে হয় বেঁচে থাকলে তো অবশ্যই তিনি যেভাবেই হোক আদনকে তার কাছে নিয়ে যেতেন। এটাই মাতৃত্ব সম্পর্কে বইয়ে পড়েছে আদন। কোনো মা-ই ইহকালে তার সন্তান ছেড়ে থাকতে পারেন না।
-তাহলে কি তার মা বেচে নেই
-কে বলেছে বেচে নেই? আছে তো! প্রতি রাতেই আদনের কল্পনায় তার মা আসেন। আদনকে নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হোন।
“তোমার নাম কি বাবা?” -আদন।
“আদন শব্দের অর্থ জানো?” -মিষ্টি।
“তোমাকে কেউ কখনো মিষ্টি বলেছে?” -না, বলেনি!
“কেনো বলেনি?” – কারণ আমার বই ছাড়া কোনো বন্ধু নেই। আর আমি আমার ডায়েরী ছাড়া কারো সাথে কথা বলিনা।
“আমি তোমার জন্য একটা বই নিয়ে এসেছি, পড়তে চাও?” -হ্যা, দিন।
“সাথে একটা ডায়েরীও দিয়ে যাচ্ছি। বইটা পড়ে কেমন লেগেছে তা আমাকে ডায়েরী তে লিখে জানাবে, কেমন?” – আচ্ছা জানাবো।
রোদেলা আদনের সম্পর্কে জেনে বিশেষভাবে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। প্রথম সাক্ষাতে সে ভীষণভাবে আদনের সম্পর্কে আকৃষ্ট হয়েছে। আহসান-রোদেলার ৪ বছরের এই দম্পত্তি জীবনে বন্ধ্যাত্ব একমাত্র অপ্রাপ্তি ছিলো। কিন্তু রোদেলা এখন আদনকে দেখে নিজ সন্তানের চাহিদা পূরণের একটা সুযোগ খুজে পেয়েছে। মাতৃত্বের তীব্র একটা ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে রোদেলা কখনোই সুখকে বরণ করতে পারেনি। আদনের মা পাওয়ার আক্ষেপ আর রোদেলার সন্তান পাওয়ার আক্ষেপ যেনো দুজনকে এখানে এক করে। আহসান বেশ শান্ত স্বভাবের কঠিন সহ্যক্ষমতার মানুষ হলেও প্রিয় স্ত্রীর এই দুঃখ সে সহজে মেনে নিতে পারেনা। সেখান থেকে পালক সন্তান খোজার সিদ্ধান্ত নেওয়া। প্রথম সাক্ষাতে আদনের প্রতি রোদেলার একটা প্রকট ভালোবাসা জন্মেছে। দুদিনের মাথায় আহসানকে সে পাগল করে ফেলেছে আদনের সাথে দেখা করার জন্য। আহসান যেকোনো মূল্যেই তার স্ত্রীর সব চাওয়া পূরণ করে বিধায় এই চাওয়া অপূর্ণ রাখারও কোনো সুযোগ নেই!
এখন আদন আর রোদেলা সামনাসামনি বসে আছে। আহসান পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আদন জানিয়েছে সে সরাসরি মৌখিক ভাবে রোদেলার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না। যদি কোনো কথা বলতে হয় তাহলে রোদেলার সাথে ডায়েরীতে লিখে লিখে কথা বলতে হবে। রোদেলা তাতেও দ্বিমত পোষণ না করে খুশিমনে কথা বলতে শুরু করলো।
“বইটা কেমন লেগেছে মিষ্টি আদন?” – অনেক ভালো।
“কতোটা ভালো” -অনেকটা তোমার মতো।
“আমি অনেক ভালো?” – হ্যা, ভালো।
“তাহলে আমার সাথে যাবে?” – যাবো, কিন্তু একটা শর্তে!
“কি সেটা?” – আমাকে নিয়ে প্রতিদিন বিকালে পার্কে ঘুরতে বের হতে হবে।
“আচ্ছা আমি রাজি। কিন্তু আমারো একটা শর্ত আছে, রাখবে?” – বলো?
“আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে হবে!”
আদনের বয়স এখন ২০ বছর। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশসেরা একটা কলেজে ফিলোসোফি নিয়ে পড়াশোনা করছে।
প্রায় ৮ বছর হয়ে গিয়েছে আহসান-রোদেলার সংসারে তার আগমনের। আদনের অনেক ভালো বন্ধু রয়েছে। তাদের সাথে আড্ডা, পড়াশোনা, ট্রাভেলিং, বই পড়া ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ সুন্দর একটা জীবন চলে যাচ্ছে তার রোদেলা সবকিছুর কেন্দ্রে থাকা আদনের প্রিয় মানুষ। প্রতিবার ট্যুর থেকে ফেরার পথে রোদেলার জন্য আদন একটি করে বই নিয়ে আসে। নিয়ম হচ্ছে দশদিনের মধ্যে বইটা শেষ করে আদনকে রিভিউ দিতে হবে!
এখনো মাঝেমধ্যে আদন তার ছোটবেলায় থাকা অরফানেজে যায়। প্রতিটা শিশুর জন্য চকোলেট, মিষ্টি, খেলনা নিয়ে যায়। স্ব-উদ্যেগে অরফানেজ লাইব্রেরিতে অনেক বই এনেছে সে। সুন্দর করে সাজিয়েছে লাইব্রেরিটা।
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে আদন বাসায় ফিরে দেখে ড্রয়িং রুমে ৪০-৪২ বছরের এক নারী বসে আছে। আদন সেটাকে উপেক্ষা করে রান্নাঘরে গিয়ে রোদেলাকে মহিলাটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে।
“আম্মু, উনি কে?” (রোদেলা চুপ করে চুলায় চা নাড়ছে)
“আম্মু বলো?” – উনি মিসেস রহমান। তোমার জন্মদাত্রী মা।
আদনের বুঝতে অনেকটা সময় লাগলো। তবুও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সে ড্রয়িং রুমে মিসেস রহমানের সামনে বসলো।
“আপনি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন কেনো?” – আদন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমি তোমায় আবার নিতে এসেছি।
“আপনি কি দয়া করে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিবেন?” – তোমার জন্মের ৭ মাসের মাথায় তোমার বাবা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যান। আমার তখন এখানে দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিলোনা। আমি ক্রমে ক্রমে চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম কিভাবে উপার্জন করে তোমাকে বড় করবো। এমন সময় আমার বর্তমান হাজবেন্ড এর সাথে আমার পরিচয় হয়। উনি কানাডায় থাকতেন। উনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু তোমাকে মেনে নিতে চান নি। তাই উপায় না পেয়ে আমি…………..
“এজন্য আপনি আমাকে এতিমখানায় রেখে নিজের জীবন ভোগের জন্য কানাডায় চলে গিয়েছিলেন? আপনি জানেন আমার সম্পর্কে কিছু? কিভাবে আমি বড় হয়ে উঠেছি, কতোটা কষ্টে আমার শৈশব পার হয়েছে?” – আমি বুঝতে পেরেছি সোনা৷ কিন্তু আমার সত্যিই কিছু করার ছিলো না। আমি নিজেও অসহায়ত্বে ভুগছিলাম। এজন্য আমি আজ তোমাকে নিতে এসেছি। তুমি আমাদের সাথে কানাডায় গিয়ে ভালো একটা জীবন পাবে।
“আমি আমার মাকে নিয়ে বেশ ভালো আছি। আমি আপনার সাথে যেতে ইচ্ছুক না। দীর্ঘ ১২ বছর আপনি একবারো খোজ নিতে আসেননি যে আপনার সন্তান কেমন আছে এতিমখানায়। তবে আমি আপনার মতো দায়িত্বহীন আচরণ কখনোই করবো না। অবশ্যই আপনি চাইলে আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন, তবে আমি আমার মাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার সামর্থ্য রাখিনা। আমাকে যদি আবার সেই এতিমখানার মতো কোনো কারাগারে আমার মায়ের সাথে বন্দি করা হয়, আমি সেখানেও থাকতে রাজি। কিন্তু আপনার সাথে সুদূর ভোগবিলাসী কানাডায় যেতে না, দুখিত!”
মিসেস রহমান এক দৃষ্টিতে আদনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আদন তার চোখের সামনে উঠে চলে গেলো। ব্যাগ হাতে নিয়ে তিনিও উঠলেন প্রস্থানের উদ্দেশ্যে, নিজের উপর নিজের তীব্র ঘৃণায় জর্জরিত হয়ে এই মানুষটা দ্বিতীয়বারের মতো আবার বাংলাদেশ ত্যাগ করতে যাচ্ছেন।
“মা? তুমি এখানে কি করছো? আমি সারা বাড়িতে তোমাকে খুজে বেরোচ্ছি।” -আদন তুমি চাইলে তোমার আসল মায়ের সাথে কানাডায় যেতে পারো। আমি কিছুই মনে করবো না।
“মা তোমাকে আমি শেষ যেই বইটা দিয়েছিলাম, সেটার শেষ লাইনটা মনে আছে?” – দেখতে হবে।
“একটু দেখে আসো, আমার জবাবটা সেখানেই আছে।” -রোদেলা বইটা বের করে শেষ পাতায় চোখ বুলালো।
“ব্যাতিক্রম ক্ষেত্রে আত্মার সম্পর্কও রক্তের সম্পর্ককে হার মানাতে বাধ্য!” রোদেলা শক্ত করে তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরলো। তার গাল বেয়ে চোখের পানি পড়ছে। এই চোখের পানি প্রকাশ করছে প্রকট ভালোবাসা আর সন্তানের প্রতি গর্ব! মাতৃত্বের এক নতুন ব্যতিক্রমী রুপ প্রকাশ করে রোদেলা আর আদন। একটি সন্তান আর মায়ের মধ্যে কেবল গর্ভের সম্পর্ক থাকে সে কথা যে ভুল, তা এখানে প্রমাণিত। আত্মিক টান, মমতাবোধ, নিস্বার্থ ভালোবাসা আবশ্যকীয় একটা অংশ এখানে!
বিকেলের শেষ ভাগ, বাহিরে বৃষ্টি পড়ছে। মৃদু বৃষ্টি, যেনো আকাশের মন খারাপ। কি মনে করে যেনো আদন রোদেলাকে নিয়ে বেড়িয়েছে। অরফানেজ এর পাশের পার্কটাতে তার মায়ের হাত ধরে হাটছে। বেশ ভালো লাগছে। হুট করে আদনের চোখ পড়লো অরফানেজের তিনতলার করিডোরের দিকে। একটা মিষ্টি ১২ বছর বয়সী ছেলে তাকিয়ে আছে! জনমানবশূন্য পার্কটাতে এক মা আর তার সন্তানকে একসাথে হাটতে দেখে শিশুটি বেশ উপভোগ করছে!
স্বাধীনতানামা
মো: ফাহাদ হোসেন ফাহিম
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
“বাজান, আর কদ্দূর? দুইদিন ধইরা না খাইয়া ধলেশ্বরীর পেটে ভাসতাছি। অথচ ধলেশ্বরীর পেট ভইরা আছে লাশে!”
“আর দুইডা ঘাঁটিতে আক্রমণ করলেই শেষ। হেরপর স্বাধীন দেশে বাপ পোলা মিল্লা পেট ভইরা খামুরে, পোকা।”
কাকজ্যোৎস্না রাতে পেছন থেকে এ ধরনের আক্রমণের প্রত্যাশা করেনি খাতির জমা অবসন্ন আর্মিরা। চোখে একেবারে সরষে ফুল দেখে মরতে হলো ভুঁইফোঁড় লোহার টুপিওয়ালাদের। বাপ বেটাকে প্রতিহত করতে গিয়ে খাবি খেয়ে যায় মিলিটারি রুই কাতলরা। ধলেশ্বরীর পেট আবারও ভরে উঠেছে ভিনদেশী দস্যুদের লাশে। স্রোতঃস্বতী নধরদেহী নদীতে কচুপাতার জলের মতো মিলিয়ে পড়ে লাশের পর লাশ। তবে লাশগুলোকে ধলেশ্বরী তার পেটে ধারণ করতে চায় না। কিন্তু কেন! নদী কি কথা বলতে জানে! অথচ বাপ-বেটা দিব্যি কথা বলে নধরদেহী ধলেশ্বরীর সাথে। ধলেশ্বরীর তরঙ্গশীর্ষে স্পষ্ট হাসির নহবত। স্রোতের টানে কচুরিপানার দলের সাথে তৃণাবর্তে মিলিয়ে পড়ে সবকিছু। পাকিস্তানি মিলিটারিদের রক্তের লাল লীন হয়ে যায় ধলেশ্বরীর নীলে। অথচ স্থির থাকে ওদের আলুথালু একপায়িটা। বাওটা খুশিতে মাথা নাড়ে। নৌকার বাওটাকে পোকা বলে নড়ির পা; ডিঙির নাম রেখেছে একপায়ি। নির্বিঘ্নে স্রোতের বিপরীতে একপায়িকে নিয়ে টক্কর দিয়ে পথ পাড়ি দেয় ওরা।
ও নিজেও শিখে গেছে কিভাবে কথা বলতে হয় ধলেশ্বরীর জলপ্রবাহের সাথে। ও বলে, ধলেশ্বরী কথা বলে, জল তার টলটলে; দস্যুদের দিব মার, টনক নড়বে এইবার। এইতো আর মাত্র ক’টা দিন, দেশটা স্বাধীন হলে ও আগের মত ধলেশ্বরীর পিঠে সাঁতার কাটবে, গাছে উঠে বুড়ি নাচন দিবে, কানামাছি খেলবে, শিঙি মাছ ধরবে, এলেবেলে খেলবে, কড়িগাঁট্টা খাবে, জালপাদ বালিহাঁস ধরবে। যেদিন থেকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা চরে ঘাঁটি গেড়েছে, সেদিন থেকে ও এলেবেলে খেলতে পারে না। অথচ মাস চারেক আগেও মিচকি, শিমুদের সাথে এলেবেলে খেলেছে ও। সবাই বলে ও নাকি এলেবেলে খেলার রাজা। চুমকি বলে ও নাকি বিল কুমিরের ছাও। ও যখন নেউলের মত গাছের উপর উঠে বসে, তখন চুমকি ওকে খেপায় এই বলে, “বান্দর, বান্দর টেসকি, তোর ছিঁড়া লুঙ্গি দেসকি!” চুমকির কথায় ওর রাগ হয় না। গাছ থেকে এক লাফে নদীতে ডুব দেওয়ার আগে ও বলে, “এইডা অইলো এলা, আমার লগে খেলা।” এখন ও অবশ্য পাকিস্তানি দস্যুদের সাথে এলেবেলে খেলতে চায়। গাঁয়ের ঝাল ঝেড়ে ও এক হাত নিতে চায়। ও স্বপ্ন দেখে এক ডুব দিয়ে ও নিঃশেষ করে ফেলেছে পাকিস্তানি দস্যুদের ঘাঁটি।
খিদের যন্ত্রণা কলিজায় হাতুড়ি মারতেই ও বলে উঠে, “আর কুলাইতে পারি না, আব্বা। হুদা পানি খাইয়া কয়দিন আর বাঁচোন যায়।” আশেপাশে নিবিড় দৃষ্টিতে বাবা তাকিয়ে দেখে সবকিছুই শেষ। বাবা কাঁদে, কিন্তু চোখের জল ছেঁড়া লুঙ্গিতে পড়বার আগেই মনটাকে শক্ত করে ফেলে বাবা। মানুষগুলো নাই, পালিয়ে গিয়েছিল যারা তারাই বেঁচে গেছে। ফসল, মাঠ, গবাদিপশু, বাড়িঘর সবকিছু শেষ করে দিয়েছে দস্যুদের দল। পরমকতায় পারু মিয়া দাদার মুখে শুনেছে বর্গী দস্যুদের কথা। কিন্তু পাকিস্তানি দস্যুদল যে বর্গীদের চেয়েও হিংস্র। ঝোপের ডাল থেকে একটা পাকনা খাইল্যা ছেলেকে দিয়ে বলে, “চাবাইতে থাক, পোকা। দেখবি আওখের মতন লাগে।” পারু মিয়া ভাবতে থাকে কিভাবে গ্রামের মানুষ, বাজার, ঘরবাড়ি, ধানখেত, বাগান সবকিছু বিনষ্ট করে দিয়েছে পাকিস্তানি দস্যু দলেরা। সব ছিল তুলসী বনের বাঘ রাজাকার বাহিনীর কাণ্ড। শুঁড়ির সাক্ষী রাজাকার। কিন্তু কেনো ওরা এমনটা করলো! দেশের খেয়ে, দেশের পড়ে কি দেশের বিরুদ্ধে কাজ করা যায়! কিন্তু ওরা যে পারে।
রাজাকারের দল সবকিছুই পারে। মনটা ভীষণ হেঁড়ে হয়ে উঠে তখন, যখন বউ আর বেটির কথা ভাবে। নিলুফা কত স্বাদের বিবি তার! আর মাইয়্যাডা, লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি লায়লার। এক রাতেই অমরাবতী গ্রামটা নরক হয়ে গেলো! একটা সময় ওরা নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য খুব আফসোস করতো। কিন্তু এখন আফসোস নেই আর। ওরা দেখে নিখাদ আপোষের স্বপ্ন। দেশটাকে স্বাধীন করতেই হবে, তবেই মুক্তি শান্তি পাবে শহিদের আত্মারা। পাকিস্তানিরা ওদের শত্রু। তার চেয়েও বড় শত্রু ঢাকের কাঠি মানুষরূপী রাজাকার বাহিনী। আর জিততে ওদেরকে হবেই। ওরা জিতলেই জিতে যাবে দেশ।
সেদিন রাতে ধলেশ্বরী বাপ-বেটাকে বলেছিল, বীরাঙ্গনাদের জীবন হরণকারী ডাকাতদের লাশের স্থান আমার পেট না, ওদের জায়গা হচ্ছে জাহান্নাম। বীরাঙ্গনা কারা পোকা বোঝেনা। ওর বয়স এগারো বছর চার মাস। ঠিক চার মাস আগে জন্মদিনের দিন চুমকি ওকে একটা লাল লুঙ্গি উপহার দিয়েছিল। কিন্তু চুমকি কোথায়, তা ও ঠিক জানে না। শুনেছে চুমকি নাকি মায়ের সাথে ভারতে চলে গেছে। ও ভাবে নদীর ওপারে যেখানটায় গরম সূর্য মুখ চুইয়ে পড়ে, সেখানটাতেই ভারত। ও স্বপ্ন দেখে দেশটা স্বাধীন হলে এক ডুবে ও ভারত চলে যাবে। চুমকিকে বালিহাঁস দিয়ে নিয়ে আসবে স্বাধীন দেশে। বালিহাঁস নাকি চুমকির খুব প্রিয়। সেদিন পড়ন্ত বিকেলে ওকে ডাকতে থাকে বাবা, “এইনো দেক পোকা। লাশ, আরেকটা লাশ। বুকে দেশের পতাকা। মুন্সীগঞ্জের দিক থেইকা আইছে। এইডা মুক্তিযোদ্ধার লাশ। আয় এরে কবর দেই।” ওরা লাশটাকে সযত্নে টেকের জঙ্গলে কবর দিয়ে বলে, শহিদের লাশ সম্মানের সাথে কবর দেওয়াও মুক্তিযোদ্ধাগো দায়িত্ব।
গতকাল রাতেই পূর্ব দিকের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছে ওরা। একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছে পাকিস্তানি দস্যুদলের আখড়া। কিন্তু আরও একটা আছে। এটা শেষ করলেই শেষ। ওরা ভাবতে লাগে সেদিনের কথা৷ সেদিন তো ওরাও শেষ হয়ে যেতে পারতো পাকিস্তানি দস্যুদের বুলেটের স্রোতে। কিন্তু ধলেশ্বরীর স্রোত যে ওদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ধলেশ্বরীর গেরিলা বাহিনী সমরকেন্দ্রে আক্রমণ করতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন শমসের আলীসহ বন্দর শহরের মিলিটারি বাহিনী। বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু দুমুখো সাপ রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানিসহ নিজেদেরকে সমর্পণ করার ফন্দি এঁটে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বড় চাল চালে। সমর্পণ করার নামে অতর্কিত হামলা চালায় ডাকাবুকো দেশপ্রেমিকদের উপর। শুধু তাই না, সেদিন রাতে গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যাও চালিয়েছে পাকিস্তানি নরপশুরা। বাপ বেটা একদিন আগে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাছ ধরতে গিয়েছিল দূরে মেঘনা নদীর মোহনায়। আর ফিরে এসে দেখে সবকিছুই লুষ্ঠিত। অবশ্য সেদিনের পর থেকে পাকিস্তানিরা ভেবেছিল চর ধলেশ্বরীতে বুঝি আর কেউ বেঁচে নেই। তাই অল্প কয়েকজন সৈনিক আর রাজাকারদের নিয়ে তিনটি ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল এখানে। ধলেশ্বরী চর স্থল থেকে বিছিন্ন, বন-জঙ্গলে আচ্ছন্ন অনেকটা বন্ধুর পথ।
বাপ-বেটা মিলে দুইটা ঘাঁটি বিনাশ করে ফেলেছে। এবারে পশ্চিমে সদর ঘেঁষা ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতে পারলেই শেষ। তারপর দিগন্তপ্রসারী শীতলক্ষ্যা নদী। পাকিস্তানিদের সাধ্য নেই মৃত্যুর ঢেউ ঠেলে আবারও চরে ভিড়ে। তবে সেখানে বিপদ অনেক বেশি। রাজাকার বাহিনী ও মিলিটারি আর্মিরা একাকার হয়ে পাহারা দেয় নদীর সীমান্ত। তাতে কি! ওদের কাছে লাঠি আছে, কড়ই গাছের বল্লম আছে, খোকা পাখি আছে; আছে মাছরাঙার ছোঁচালো মুখ; সবচেয়ে বড় শক্তি আছে ‘দেশপ্রেম’। গোলাবারুদ সহ দুইটা পিস্তলও আছে ওদের। প্রথম ঘাঁটি আক্রমণ করতে গিয়ে পাকিস্তানিদেরকে মেরে উদ্ধার করে এনেছে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা পোকা।
তাইতো খুব সহজেই উড়িয়ে দিতে পেরেছে দ্বিতীয় ঘাঁটিটা। পারু মিয়া আগে মাছ মারতো, এখন মারে পাকিস্তানি দস্যু ও মীরজাফরদের। এর আগে পোকার শক্ত বল্লমের আঘাতে রাজাকার পিচ্চি প্রাণ হারিয়েছে। রাজাকার পিচ্চিকে মেরে ও বলেছিল, “এইডা অইলো এলা, আমার লগে খেলা।” কিন্তু পিচ্চির সাধ্য কি ওর সাথে খেলে! পোকা পিস্তল চালাতে জানে না। পিস্তল অনেক ভারী। অবশ্য বাবা পারে। এর আগে তিনি শিখেছিলেন। নৌ-ডাকাতদের থেকে বাঁচতে বাবার কাছ থেকেই পিস্তল চালনা শিখেছিল পারু মিয়া।
স্রোতের অনুকূলে সন্তর্পণে এগুতে থাকে একপায়ি। পোকা পুত পুত শব্দ শুনে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, এই পাখিরা পুত পুত করে কেন গো আব্বা? এইডা অইলো আইরে খোকা পাখি, পোলারে খুঁজে। কেন খুঁজে? নৌ ডাকাতেরা গ্রামে আইসা একবার জোর কইরা একজনের পোলারে তুইল্লা লইয়া গেছিল। পোলারে খুঁজতে গিয়া ঐ বাপ মইরা যায়। মৃত্যুর পরে নাকি হেই বাপ পাখি অইয়া জন্মাইছে। পোলাডারে এহনও খুঁজে। আর কয়, পুত পুত পুত…” ও চুপটি করে বসে থাকে। শরীর ভেঙে পড়েছে ওর। বন্য ফল, আধা কাঁচা সবজি, নদীর জলে কি আর চলে! তবুও অভিযোগ নেই ওর। আছে আপোষ, দেশকে স্বাধীন করার শক্তি। চর ধলেশ্বরী স্বাধীন হলেই স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। ও স্বপ্ন দেখে তাই। শরীরের ভাঙন মেনে নেয়া যায়, স্বাধীনতার ভাঙন যায় না। এর আগেও চর ধলেশ্বরীতে হামলা চালিয়েছিল বান্ডারি চেয়ারম্যান। উর্বর পলিমাটি, মাছের আখরা দেখে কিছুতেই তর সইছিল না তার। রাজাকার বাহিনীকে নিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি দিয়ে সেদিনের হামলা ছিল তারই কাজ। চরের ফল, মাছ, গরুর দুধ সবকিছু পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। কিন্তু মানুষ! পাকিস্তানিরা কি মানুষও খায়! মানুষ হয়ে মানুষকে কি খাওয়া যায়! পোকা বুঝে না সেকথা। কিন্তু বাবা বুঝে।
হঠাৎই রেডিও’র শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় পোকার। খুশিতে আপ্লুত হয়ে বাবাকে বলে, আব্বা, এইযে হোনো। দেশের এক মুড়া স্বাধীন অইয়্যা গেছে। বাবা খুশি হয়ে পোকাকে জড়িয়ে ধরে আবারও বলে উঠে, আর দুইডা দিন কষ্ট কর পোকা। হেরপর স্বাধীন দেশে বাপ পোলা মিল্লা পেট ভইরা খামু। পোকা ঘুমিয়ে পরতেই বাবা পুতুলগুলোকে তুলে রাখে পঙ্কিল প্রান্তরের মোড় থেকে। পোকা পুতুলগুলোকে ভাবে ওর এলেবেলে খেলার সিপাহি আর ও, ধলেশ্বরী চরের রাজা, শীতলক্ষ্যার রাজা। যতদূর দৃষ্টি যায় সবকিছুই ওর। ওর করুণ শরীরে জুনিপোকারা খেলে। চপলমতি এক জুনিপোকা ওকে বলে, “দেশটা স্বাধীন হইলে আমাগো হগল আলো তোমারে দিয়া দিমু পোকা ভাই। হেই আলো দিয়া তুমি সুন্দর একটা জামা কিনবা।” পোকা কাঁদে। নদীর তীরে ঘাসের উপর শুয়ে ওর মনে হয়, কি সুন্দর পৃথিবী, কি সুন্দর আকাশ, কি সুন্দর জীবন, কি সুন্দর স্বাধীনতা!
রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানিরা যেদিন চরে আক্রমণ করে, সেদিন গ্রামে ছিল মেলা। পুতুল নাচের সব পুতুলগুলোকে পাকিস্তানিরা যখন নদীতে ফেলে দেয়, সেগুলো আটকা পড়ে কচুরিপানার ঝোপে। আর ওরা তুলে রেখে দেয় নৌকায়। এতে অবশ্য একটা ফায়দা হয়েছে ওদের। রাতে যখনই ওরা পাকিস্তানিদের ঘাঁটিতে অভিযান চালানো শুরু করতো, তখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুতুল বসিয়ে রাখতো। এতে করে পাকিস্তানি আর্মিরা ভুল জায়গায় গুলি ছুড়তো আর ভাবতো এখনো বুঝি অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছে গ্রামে। এভাবেই ভয়ে ভয়ে অনেক রাজাকার পালিয়ে বেঁচেছে চর ছেড়ে।
বাবা ওকে বলে, “হোন পোকা। ফজরের আগেই পশ্চিম ঘাঁটিতে আক্রমণ চালামু।” আক্রমণের কথা শুনে ও খুব খুশি হয়। কারণ দেশটা স্বাধীন হলে ও পেট ভরে খেতে পারবে, দেশের মানুষও খাবে পেট ভরে। অবশ্য আক্রমণ করার আগে ওকে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। গভীর রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে ও চলে আসে সদর ঘেঁষা পশ্চিম ঘাঁটিতে। দূর থেকে দেখে, লোহার টুপি মাথায় দিয়ে পাহারা দিচ্ছে সেপাইয়ের দল। ও বলে কেয়াপাতার সেপাই। দূরে দূরে সাদা পুতুলগুলো সাজিয়ে রেখে চলে আসে ও। কিন্তু ফিরতে খুব কষ্ট হয়। অন্ধকারে কাঁদায় পা দিতেই শামুকে কেটে যায় পা। ও নীল প্লাস্টিক দিয়ে বেঁধে রাখে পা’টা। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছে খুব। অবশ্য এখন বৃষ্টি নেই। নৌকা থেকে নেমে বাবা যখন বন্দুক নিয়ে মিলিটারি ঘাঁটিতে আক্রমণ করে, তখন ও গাছের উপর উঠে বল্লম ছুঁড়ে মারে। এর আগে রাজাকার পিচ্চি সহ বিশজন পাকিস্তানি মিলিটারি প্রাণ হারিয়েছে ওর বল্লমের আঘাতে। সেবার সময়মত বল্লম ছুঁড়ে না মারলে তো ধরাই পড়ে যেতো বাবা। আর মাত্র একটা ঘাঁটি। তারপর একটা দেশ, একটা জাতি, একটা লালিত স্বপ্ন, একটা স্বাধীনতা। কাঁধে দশটা বল্লম আর মাথায় লোহার টুপি দিয়ে সন্তর্পণে গাছে উঠে পড়ে পোকা। মিলিটারিরা টের পায় না। একশো কেয়াপাতার সেপাই আর বান্ডারি চেয়ারম্যান সহ বারো জন রাজাকারের বেশি মানুষ হবে না ঘাঁটিতে। ছেঁড়া লুঙ্গিটায় শক্ত করে কাছার বেঁধে বের হয় বাবা। পিস্তল একটা হাতে, আরেকটা কাঁধে।
গাছের উপর থেকে সূচালো বল্লমটা ছুড়ে মারতেই বিঁধে যায় পাহারারত সৈনিকের বুকে। ঝোপের আড়াল থেকে তাক করে গুলি ছুড়তে শুরু করে দেয় বাবা। দশজন সৈনিক বেহুঁশ। মরে গেছে একেবারে। অবিশ্রান্তভাবে পাকিস্তানি মিলিটারিরা গুলি চালাতে থাকে সাদা রঙের পুতুলগুলোর দিকে। ঝোপের আড়াল থেকে গুলি চালাতে থাকে বাবাও। ওর ছয়টা বল্লমে ছয়জন শেষ। এর মধ্যে দুইজন রাজাকার। একেবারে চিঁড়ে গেছে বান্ডারি চেয়ারম্যানের লালচে কলিজাটা। এদিকে গুলি করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে বাবা। ওর কাছে এখন একটা বল্লমই আছে। উপর থেকে নিশানা করতে গিয়ে পিছলা গাছের ওরসা মগডাল থেকে নিচে পড়ে যায় ও। ভেঙে যায় বা হাতটা। কিন্তু কাদায় শুয়ে ও ডান হাত দিয়ে বল্লমটা খুব জোরে ছুড়ে মারে। একেবারে বিঁধে যায় লোহার টুপিওয়ালা সৈনিকটার বুকে। কিন্তু সৈনিকের পিস্তলের গুলিও এসে আঘাত করে ওর অকুটিল হৃদয়টাতে। এদিকে বাবার কাছে চিরদিনের জন্য কুপোকাত হয়ে পড়ে রাজাকারসহ পাকিস্তানি মিলিটারির দল। সব মরে একেবারে নিষ্প্রভ ভূত।
ও চেয়ে থাকে অপলক। বাবা জোরে জোরে বলে উঠে, জয় বাংলা, বাংলার জয়। জোর গলায় ও নিজেও বলতে চেষ্টা করে, জয় বাংলা, বাংলার জয়। ওর শব্দ বাবার কানে পৌঁছায় না। বাবা ওকে খুঁজতে খুঁজতে বলতে থাকে, পোকারে, কইছিলাম না স্বাধীন দেশে বাপ পোলা মিল্লা পেট ভইরা খামু.. তুই কই গেলি পোকা?… কিন্তু বাবা খুঁজে পায় না ওকে। উপর থেকে পড়ে হাত পা ভেঙে যাওয়ায় উঠে দাঁড়াতে পারে না পোকা। কাটা পায়ের রক্তে আরও রক্তিম হয়ে উঠেছে ওর কাছার দেওয়া লাল লুঙ্গিটা। পূর্ব দিগন্তের মেঘগুলো মিলিয়ে পড়ছে কাঁদতে কাঁদতে, দিগন্তে স্বাধীনতার আলোক সমারোহ ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। স্বাধীনতার মোলায়েম আলো গায়ে লাগতেই ও বলে উঠে, এইডা অইলো এলা, পাকিস্তানি গো লগে খেলছি আমি খেলা। বিরান আকাশের মেঘ চিঁড়ে হাসিমুখে উড়ে যেতে থাকে ওর তন্ময় প্রাণবায়ু। জুনিপোকার দল সর্বশক্তি দিয়ে আটকে ধরে ওকে আর তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে বলে, দেশের জন্য জীবন দিয়া লাল করলো যে নিজের জামা, শহিদ পোকার মৃত্যু নাই, পোকার নামেই স্বাধীনতানামা।
সম্প্রিতির বিজয়
লুবাবা যাহিন
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
১৯৫০এর দশকের শুরুর দিকে, বাংলাদেশ (তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত) ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের অধীনে সংগ্রামরত একটি অঞ্চল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সাম্য, স্বাধীনতা এবং তাদের অনন্য বাঙালি সংস্কৃতির সংরক্ষণ কামনা করেছিল। এই সময়েই সাহসী ব্যক্তিদের একটি দল আবির্ভূত হয়েছিল, যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচিত, যারা জনসাধারণের জন্য সমাবেশ করবে এবং তাদের লালিত আদর্শের জন্য লড়াই করবে।
গল্পটি শুরু হয় সোনারগাঁও নামে একটি ছোট গ্রামে, যেখানে সবুজ মাঠ আর মেঘনা নদীর স্বস্তিদায়ক আলিঙ্গন। এটি ছিল বাঙালি ঐতিহ্য এবং প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক চর্চায় আবদ্ধ একটি গ্রাম, যা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া নিপীড়নমূলক নীতির কারণে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গ্রামবাসীদের মধ্যে রিয়াজ আহমেদ নামে এক তরুণ ও আবেগপ্রবণ ব্যক্তি ছিলেন। রিয়াজ একজন শিল্পী ছিলেন, যিনি তাঁর শিল্পে সান্ত্বনা এবং শক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই দমন-পীড়নের ভার তার এবং তার গ্রামবাসীদের ওপর চাপা পড়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের সাহসী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, রিয়াজ তার জনগণের অধিকারের জন্য লড়াই করার একটি জ্বলন্ত ইচ্ছা অনুভব করেছিলেন। রিয়াজ জানতেন তাদের সংগ্রাম সফল করতে হলে বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
সোনারগাঁওয়ের প্রাণকেন্দ্রে, তিনি গোপন সমাবেশের আয়োজন করতেন যেখানে তিনি অতীত ও বর্তমানের মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শোনাতেন। গল্পগুলি প্রত্যেকের মধ্যে একটি শিখা প্রজ্বলিত করেছিল যারা উপস্থিত ছিল এবং শীঘ্রই, আশেপাশের গ্রামের অন্যরাও তাদের কাজে যোগ দেয়। সাম্য, স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতির জন্য তাদের লড়াই বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিল, স্থানীয় সংবাদপত্রে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল এবং প্রাণবন্ত শিল্পকর্ম তৈরি করেছিল যা বাঙালি ঐতিহ্যের প্রকৃত সারাংশকে চিত্রিত করেছিল। রিয়াজ এবং তার সঙ্গীরা বিশ্বাস করতেন যে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক পরিচয় তাদের সংগ্রামের জন্য অত্যাবশ্যক, কারণ এটি জনগণকে একত্রে আবদ্ধ করে এবং তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।
যাইহোক, আন্দোলন গতি লাভ করার সাথে সাথে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ তাদের হুমকি হিসাবে দেখে এবং বর্বরতার সাথে প্রতিক্রিয়া জানায়। শান্তিপূর্ণ সমাবেশগুলিকে কাঁদানে গ্যাস এবং লাঠিপেটা করা হয়েছিল এবং অনেক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের নৃশংসতা শুধুমাত্র প্রতিরোধের আগুনে জ্বালানি দিয়েছিল, রিয়াজ এবং তার কমরেডদের ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছিল। প্রতিবাদ এবং সাহসী প্রতিরোধের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহানুভূতিশীলরা তাদের সমর্থন জানায়। সাহায্য সংস্থাগুলি তহবিল এবং সংস্থান সরবরাহ করেছিল এবং বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা এই কারণের সাথে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্ব সম্প্রদায় সংগ্রামের তাৎপর্য স্বীকার করেছে, এটিকে শুধু বাংলাদেশের জনগণের জন্য নয়, সাম্য ও মানবাধিকারের সার্বজনীন মূল্যবোধের লড়াই হিসেবে দেখেছে। রিয়াজ এবং তার সহ-মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শক্তিকে একটি কার্যকর আন্দোলনে পরিণত করার লক্ষ্যে একটি যুক্তফ্রন্ট সংগঠিত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
তারা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ, কৌশল এবং জনগণকে একত্রিত করার জন্য ভূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। তাদের বার্তা প্রদেশের প্রতিটি কোণে পৌঁছেছে, হাজার হাজার মানুষ নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে উঠতে অনুপ্রাণিত করেছে। ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম তার আত্মত্যাগ ছাড়া ছিল অন্য কিছু ছিল না। অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিপীড়ন, কারাবরণ, নির্যাতনের সম্মুখীন হন, এমনকি প্রাণ হারান। কিন্তু তাদের আত্মত্যাগই আন্দোলনের সংকল্পকে শক্তিশালী করেছে। তাদের সাহসিকতা ও সংকল্প অন্ধকার ভেদ করে বাংলাদেশের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ দেখায়। অবশেষে বহু বছর নিরলস প্রতিরোধের পর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশের জন্ম শুধুমাত্র রিয়াজ এবং তার কমরেডদের জন্য নয় বরং সাম্য, স্বাধীনতা এবং তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য লড়াই করা প্রতিটি ব্যক্তির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বিজয় নিশ্চিত করেছে। আজ, বাংলাদেশ তার জনগণের অদম্য চেতনার সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যারা তাদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করেছে এবং আত্মত্যাগ বিসর্জন দিয়েছে। রিয়াজ আহমেদ এবং অগণিত মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকার দেশের ইতিহাসে নিহিত রয়েছে, তাদের অটল দৃঢ়তা, সাহস এবং তাদের ভূমির প্রতি ভালবাসার অবিরাম অনুস্মারক।
স্বপ্নের মতো ১ দিন!
নুজহাত মাহিরাহ
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
“আমি লিলি, বয়স ১৪। আমার বয়সের মেয়েরা সাধারণত খেলাধুলা, পড়াশোনা ছবি আঁকা বা তাদের শরীরচর্চার প্রতি মনোযোগী থাকে তবে আমার ক্ষেত্রে এটি ভিন্ন। আমি বই পড়তে পছন্দ করি, প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কিত বই। বলতে গেলে ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা ও লেখালেখি করাটাই আমার শখ। আমি…”
লেখা শেষ হওয়ার আগে মা ডাকলেন খাওয়ার জন্য। আমি ডায়েরিটা বন্ধ করে আমার ইতিহাস সম্পর্কিত বইগুলো এক পাশে রেখে দিলাম। নিচে নেমে দেখলাম আমাদের রোবট রান্না শেষ করে সেগুলো টেবিলে সাজিয়ে দিচ্ছে। আমার বাবা খাওয়ার টেবিলে বসে মোবাইল ফোন ঘাটছেন। বলতে গেলে খাওয়া শুরুর আগে এটিই তার অভ্যাস। আমি খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে এলাম। ডায়েরিটা নিয়ে আর বসলাম না। কম্পিউটারের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম ১৯৭১ সালে ঘটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি খোলা। আমি বেশ কিছু দিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও বই ঘেটে গবেষণা করছি। কম্পিউটার বন্ধ করে ঘরের লাইট নিভালাম। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো।
রাত ২ টা বেজে ৩২ মিনিট। একটি অদ্ভুত আওয়াজ শুনে আমার ঘুম ভাঙ্গল। উঠে লাইট জালালাম শুনতে পেলাম কেউ কথা বলছে কিন্তু গলার স্বর টা অচেনা। আমি আওয়াজ অনুসরণ করে বাহিরে বের হয়ে আসলাম। আমার বাগানের পিছনে তাকিয়ে দেখি একটি বিড়াল তবে বিড়ালটি স্বাভাবিক নয় সে মানুষের মতো দুই পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলো এবং আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বিড়ালটি কথা বলতে পারছিলো! আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তাই চোখ দুটো আঙ্গুল দিয়ে ঘষে আবার সামনের দিকে তাকালাম। আমি তো ঠিকই দেখছি তবে এটা কি করে সম্ভব? আমি বিড়ালটির কাছে গেলাম। দেখলাম বিড়ালটি একটি ইঁদুরের ফাঁদে তার একটি পা আটকে ফেলেছে। আমি তার কাছে যেতেই সে বললো
“হ্যালো আমি রুবি আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে আমি এই ফাঁদটি থেকে মুক্ত হবো তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?” আমি অবাক হয়ে বললাম “তুমি কথা বলতে পারো? তুমি তো কোনো সাধারণ বিড়াল নও, তুমি কে?” রুবি বললো “আমি তোমাকে পরে বলছি আগে আমার পা এই ফাঁদ থেকে মুক্ত করো, আমি ব্যাথা পাচ্ছি।” আমি সাথে সাথে টান দিয়ে সে ফাঁদটি সরালাম এবং বিড়ালটি স্বস্থি পেলো।
রুবিঃ আমি বেলভিন ২৩ নামক একটি গ্রহের প্রানী। পৃথিবীর প্রানীর থেকে আমি তাই বিচিত্র। আমি আমার সাথীদের নিয়ে মহাকাশ ভ্রমণে বেড়িয়েছিলাম। কিন্তু আমার মহাকাশযানের একটি ইঞ্জিনে সমস্যা হওয়াতে মহাকাশযানটি ব্লাস্ট হয় এবং আমরা ছিটকে ভিন্ন ভিন্ন গ্রহে পড়ি। তাই আমি এখন এখানে।
আমি যেন আমার কান ও চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি আমার বিস্ময় ঢেকে বলিঃ আমি লিলি এই বাসাটি আমার, তোমার হাতে ওটা কি? বলে আগ্রহের সাথে তাকিয়ে থাকলাম।
রুবিঃ এটি টাইম ট্র্যাভেল করার একটি যন্ত্র এটি ব্যাবহার করে তুমি অতীতে যেতে পারবে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এ আমি কি শুনছি! টাইম ট্র্যাভেল! এটা বাস্তবেও সম্ভব? আমার কিশোরী মনে একটি দুষ্টু বুদ্ধি এলো আমি রুবি কে বললামঃ আচ্ছা রুবি তুমি কি আমাকে টাইম ট্র্যভেল করিয়ে অতীতে নিয়ে যেতে পারবে?
রুবিঃ অবশ্যই পারবো তবে এটি ঝুকিপূর্ণ হতে পারে।
আমিঃ কোনো সমস্যা হবে না আমি ইতিহাস নিয়ে খুবই আগ্রহী এবং যখন আমি শুনেছি টাইম ট্র্যাভেল করে অতীতে যাওয়ার যন্ত্র আছে তখনি ভেবেছি অতীতে গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসবো!
রুবিঃ ঠিক আছে তুমি যেহেতু আমাকে সাহায্য করেছো তাই আমিও তোমাকে সাহায্য করতে পারি। বলে রুবি তার যন্ত্রটি বের করলো এবং সাথে সাথে তা একটি দরজায় রুপ নিলো। রুবি আমাকে একটি স্যুট দিয়ে বললো পরে নিতে।
রুবিকে বললাম: “আমি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় যেতে চাই” আমি স্যুটটি পরে রুবির হাত ধরে টাইম ট্র্যাভেলের দরজার ওপাশে গেলাম। সাথে সাথে চারিপাশ তীব্র আলোয় ভরে উঠলো। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। চোখ খুলতেই দেখি আমি আর রুবি একটি ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। চারিপাশে অসংখ্য লাশ পড়ে আছে। আহত মানুষ পড়ে আছে রাস্তায়। আমাকে রুবি বললো “এখানে কিন্তু আমাদের খুবই সাবধানে থাকতে হবে পরিস্থিতি ভালো নয়।”
আমি চারপাশে দেখলাম মানুষরা ছুটোছুটি এবং কিছুক্ষন পর পর কিছু মিলিটারি পোশাক পরিধানরত লোক গুলিবর্ষণ করছে। হঠাৎ আমি দেখলাম একটি লোক দূর থেকে আমার দিকে বন্দুক তাক করেছে। ভয়ে আমি চিৎকার দিতে গেলে একটি মেয়ে আমাকে আর রুবিকে টেনে নিয়ে অন্য গলিতে চলে আসে এবং আমাদের তাকে অনুসরণ করে দৌড়াতে বলে আমরা মেয়েটির কথামতো কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর শহরের একটু বাহিরে গ্রামের দিকে আসি। মেয়েটি তার ঘরের দিকে আমাদের নিয়ে যায়। উঠানে বসতে বলে, পানি এনে দেয়। আমি আর রুবি পানি খেতে থাকি। মেয়েটি বলে “আমি মিনা এই গ্রামে থাকি তোমরা কি নতুন? এম্নে রাস্তায় ঘুইরা বেড়াইতাসিলা ক্যান? কিছু যদি হইয়া যাইতো? জানো না এহন আমাগো কি অবস্থা পাকিস্তানিরা আমাগোর উপর কেম্নে জুলুম করতাসে?”
আমিঃ আমি বুঝতে পেরেছি।
মিনাঃ তুমি কই থাহো?
আমি রুবির দিকে ঘুরে তাকালাম সে ইশারা দিয়ে আমাকে বলতে নিষেধ করলো।
আমিঃ এ জায়গা থেকে বহু দূরে তুমি চিনবে না।
মিনাঃ আইচ্ছা।
আমি তাকিয়ে দেখলাম তারা দারিদ্রতা নিয়ে জীবন কাটায় এক মুঠো ভাত ৪ জনে মিলে খায়!
হঠাৎ একটি লোক এসে চিৎকার করতে করতে বললো “ওরা আইতাসে এইহানেই আইতাসে পালাও তোমরা যে যার হাতিয়ার লইয়া রাহো যেই কোনো সময় আক্রমণ চালাইবো তারা”। আমি আর রুবি এটি শুনে অবাক হয়ে রইলাম।
মিনাঃ আমাগো এইহান থেকে যাইতে হইবো এহনই!
মিনা তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতে থাকলো আমি আর রুবিও তাদের সাথে গেলাম। আশে পাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কিভাবে লড়ছে তারা ! পাকিস্তানি মিলিটারি এলোপাথারি গুলি বর্ষণ করে গেলো এবং বাঙালিরা তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে তাদের হাতের কাছে যেকোনো হাতিয়ার নিয়ে লড়াই করতে নেমে পড়লো। ট্যাংক নিয়ে হামলা চালালো পাকিস্তানিরা। আমাদের বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে করতে নিজেদের প্রাণ হারালো।একের পর এক মৃত্যু হলো বাঙালিদের। এসব দৃশ্য দেখে ভয়ে আমি এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। রুবি আমাকে টেনে নিয়ে টাইম ট্র্যাভেলের দরজায় নিয়ে গেলো এবং আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে চলে আসলাম। কিছুক্ষন পর আমরা নিজেদের আবিষ্কার করি আমাদের বাগানে। আমি বিস্ময়ের সাথে রুবির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
রুবিঃ আমার সঙ্গীরা আমাকে কাল রাতে নিতে আসবে ততক্ষণ আমাকে তোমার এখানে থাকতে দিবে?
আমিঃ অবশ্যই! তবে কাউকে তোমার ব্যপারে টের পেতে দেয়া যাবে না তুমি আমাদের বাসার নিচের স্টোর রুমে থাকবে।
এই বলে আমি তাকে স্টোর রুমে নিয়ে গেলাম। নিজের রুমে এসে আমি আমার পুরো অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লিখে রাখলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৩ টা বেজে ৪ মিনিট। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আজ ১৪ এপ্রিল! মানে আজকে পহেলা বৈশাখের দিন। গতকাল রাতের কথা ভুলে গিয়ে আমি জলদি নিচে নেমে মাকে জড়িয়ে ধরি। মা আমাকে নাস্তা দিলে নাস্তা খেয়ে আমি বৈশাখি মেলার জন্য তৈরি হলাম হঠাৎ আমার রুবির কথা মনে পড়লে আমি সবার আগোচরে স্টোর রুমের দিকে গেলাম রুবিকে বললাম তুমি আমার সাথে মেলায় যাবে? রুবি খুশিতে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে যাবে। আমি তাকে আমার কাধের ব্যাগে লুকাতে বললাম। রুবি কে ব্যাগ এ নিয়ে আমি বাবার সাথে গাড়িতে করে মেলায় গেলাম। সব মেয়েরা আজ বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি পরেছে আর ছেলেরা পাঞ্জাবি। সবাই খুব সুন্দর করে সেজেছে। আমি মেলায় হাটতে হাটতে একটি খাবারের স্টলে গেলাম সেখানে কলাপাতা ও মাটির প্লেটে পান্তা ভাত ও ভর্তা সাজানো হয়েছে আমি আমার ব্যাগ টি নিচে রেখে চেইন হাল্কা খুলে দিলাম ও খাবার খাওয়া শুরু করলাম।
রুবিঃ তোমাদের পৃথিবিটা তো খুব সুন্দর। তুমি এইগুলো কি খাচ্ছো?
আমিঃ এইগুলো হলো বাঙালি দের প্রিয় খাবার। আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে ভাত, ভর্তা, মাছ ইত্যাদি।
রুবিঃ তাই! তোমরা গলায়, কানে, হাতে ওগুলো কি পড়েছো?
আমিঃ এইগুলো অলংকার। বাঙালি সংস্কৃতিতে সাজগোজের বেশ বাহার! চুড়ি, কানের দুল, গলার হার আরো কতো কি! দেখো সবাই কতো সুন্দর করে সেজেছে।
রুবিঃ হুম তা দেখছি। তোমাদের বাঙালি সংস্কৃতি খুব সুন্দর।
রুবিঃ আচ্ছা ঐ দিকটায় কি হচ্ছে?
আমিঃ ওহ! ওখানে একটি নাটকের আয়োজন করা হয়েছে কিভাবে যুগের পর যুগ নারীদের সমাজে পরিবর্তন আসে এ বিষয়ে
রুবিঃ মানে?
আমিঃ মানে হলো অতীতে নারীদের পুরুষদের মতো ঘরের বাহিরে গিয়ে কাজ করা কিংবা পড়াশোনা করা সম্ভব হয়ে উঠতো না। সকলে মনে করতো নারী জন্ম হয়েছে ঘরের কাজ করার জন্য এবং পুরুষরা বাহিরে। এ বৈষম্য তখনকার দিনে বেশ সাধারন ছিলো। নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিলো না, তাদের কে শুধু ধর্ম এবং ঘরোয়া শিক্ষা দেয়া হতো। তবে ধীরে ধীরে উন্নতি আসে এখন আর নারীরাও পুরুষদের মতো শিক্ষা অর্জন ও বাহিরে কাজ করতে পারে তাদের কে আর ছোট করে দেখা হয় না। এ উন্নতিতে বাংলাদেশে বেগম রোকেয়ার একটি বড় অবদান ছিলো। তিনি রাতের বেলা নিজের বড় ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে আর স্বামীর নামে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠান করেন। এই বৈষম্যের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
রুবিঃ তাই! আমিঃ হুম। তারপর রুবিকে নিয়ে মেলায় আরো বেশ কয়েক জায়গায় ঘুরলাম। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে আসলো। বাড়িতে ফিরে আমি বাগানে গেলাম। রাত ৮ টা বেজে ২০ মিনিট বাগানে একটু দূরে দেখলাম একটি মহাকাশযান! রুবি বললো এখন তাকে যেতে হবে। আমি রুবিকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালাম। রুবি মুচকি হেসে চলে গেলো বহু দূরে। আকাশের সাথে মিলিয়ে গেলো সে মহাকাশযান। আমি আমার ঘরে ফিরে সব কিছু আমার ডায়েরিতে লিখে রাখলাম। এখনো যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু ঘটে গেলো! এই ১ দিন ছিলো পুরো স্বপ্নের মতো। আদৌ কি এটা সম্ভব? হয়তো…
ট্রেনের স্মৃতি
মোঃ আশিকুর রহমান শাহ্
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছিলাম৷ আমার সিটে এবং তার পাশের সিটে দুইজন মা-বয়সী নারী বসে। টিকিট দেখানোয় একজন মুখ কুচকিয়ে দাঁড়িয়েই যাত্রা শুরু করলো৷ কি অদ্ভুত! ঘন্টার পর ঘন্টা কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলি, অথচ সিটের জন্য মাঝবয়সী নারীটাকে দাঁড় করিয়ে দিলাম৷ ভাবলাম অকারণে কত দাঁড়ায় থাকি, যাই আবার একটু রেলের দরজায় হাওয়া খাই৷ বসতে দেয়ায় তারা কি খুশি! নামার আগে দোয়া দিয়ে গেলো, বড়ো হও বাবা!
আমার সিটের পাশেই দুইজন যুবক। তাদের সাথে পরিচিত হলাম৷ এইচএসসি ১ম বর্ষে পড়ে৷ উনি নাকি শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরত আসছেন৷ পরে শুনি উনাদের প্রেম ফেইসবুকে, আজকে এংগেইজমেন্ট শেষ করে সপরিবারে এখন বাসায়। এদিকে ভ্রমনের এক অংশে রেলের দরজা থেকে কিছু পানির বোতল আমার হাতে দিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যগণকে দিতে বললো৷ তার অনুমতি সাপেক্ষে আমিও একটু পানি খাচ্ছিলাম। এমতাবস্থায় দরজার কাছে থাকা এক মহিলা পানি চাইলো৷ অন্যের বোতল হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাস করলাম, তাকে কি বোতলটা দেয়া যায়?
নিজের বোতল হলে তো অবশ্যই দিতাম৷ কিন্তু সে পানি না দিয়ে আমার হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে সরাসরি তার পরিবারকে দিয়ে দিলো। মনে মনে ভাবলাম, কাজটা ভালো হলোনা বটেই।
যাই হোক, একটু পরে আবার দরজায় গেলাম৷ আমাকে দেখেই মহিলাটা বলে, একটু পানি চাইলাম দিলা না। বোতলটা অন্যের এরকম টা জানালাম। এরপর আল্লাহ নবীকে স্বরণ করে আমাকে শুনিয়ে গাইতে শুরু করলো, আমি গরীব তাই ছেলেটা আমাকে পানি দিলো না আর টিটি আমাকে সিট দিলো না। হায় জ্বালা! একই যাত্রায় কেউ আশীর্বাদ করে গেলো আর কেউ ভর্ৎসনা করে গেলো।
ছুটি শেষ করার পরে এবার বাড়ি থেকে ফিরে যাচ্ছি যশোরে। রেল স্টেশনে পৌছানোর পর ট্রেনে উঠে দেখি আমার সীটে অল্পবয়সী সুন্দরী এক রমনী বসে। কৌতুহল মনে জিজ্ঞাস করেছিলাম, “আপু সিটটা কি আপনার?” মাথা নাড়িয়ে কিছু না বলেই দাড়িয়ে গেল। নিজের সিটে বসার পর বল্লাম, “টিকেট পান নাই?” সে মাথা নাড়ালো আর পাশ থেকে তার বাবা উত্তর দিলো, “আজকেই ট্রেনে ফিরতে হবে সেইটা জানতাম না, তাই টিকিট করা হয়নি।” তা শুনে বললাম, “এইভাবে তো চলাচল করা কষ্টকর। কোথায় যাবেন?” উত্তর করলেন, “দর্শনা”; যা কিনা কয়েক ঘণ্টার পথ৷
এরপর চুপ করে যাত্রা শুরু করলাম৷ এভাবেই যাত্রা চললো ঘন্টা খানেক৷ এরপরে পাশের সিটের ৪০ ঊর্ধ্ব বয়সী এক মুরুব্বি নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে মেয়েটিকে বসতে দিলেন। আর নিজে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর তার বাবার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুরু হলো তাদের গল্প। মানুষের দূর্ভোগে এমন সহমর্মিতা দেখে বেশ ভালোই লাগলো। মজার ব্যাপার হলো ঘন্টা খানেক যাত্রার পর মেয়েটা আর তার বাবা দুজনেই মুরুব্বিকে তার সীটে বসার জন্য রিকোয়েস্ট করতে শুরু করলো। মুরুব্বি মানুষটা “না” করে আরো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকারই ইচ্ছা প্রকাশ করলেন৷ তিনি ২য় বারের অনুরোধে নিজের সিটে বসতে রাজি হলেন।
পাশের সিট থেকে পিকনিকের বাসে বেশিরভাগ রাস্তা লাফিয়ে-দাঁড়িয়ে মজা করে বেড়ানো আমি নিজ সিটে বসে সবকিছু একটু অবাক হয়েই পর্যবেক্ষণ করছি৷ কিছুক্ষণ পর আমিও একটু ইয়ে মানে বসতে দিলাম তার বাবাকে৷ কিন্তু লোকটি সুযোগ পেয়েও সম্পুর্ণ রাস্তায় একবারও বসলো না; নিজের মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটাকে সিটে বসিয়েই যাত্রা শেষ করলো।
খুব মনে পড়ে সোনালী অতীত
নাছিম উদ্দিন ভুঁঞা
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা যত বড় হই ততোই অতীতের কথা মনে পড়ে, অতীতের ফেলে আসা দিনগুলো ফিরে পেতে চাই। পৃথিবীতে এতো এতো প্রাণীর মধ্যে আমরা শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ হিসেবে জন্মেছি এটা আমাদের পরম সৌভাগ্য। মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর আমরা শৈশব, কৈশোর, যৌবন, এবং বৃদ্ধকালের সময়টা পার করে থাকি। যখন আমরা কিশোর থাকি তখন আমরা হতে চাই তাগড়া যুবক আবার যখন যুবক হই তখন মনে পড়ে ফেলা আসা সোনালী অতীতের কথা তখন অনেক করে চাই আবার পিছনে ফিরে যাওয়ার কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙতে চাইতো না তারপরও আম্মু ডাকতেই থাকতো আরবী পড়তে যাওয়ার জন্য অনেকক্ষণ ডাকার পর যখন উঠতাম না তখন আব্বুর এক ডাকে উঠে চলে যেতাম আরবি পড়তে মকতবে। এক সাথে দলবেঁধে মকতবে যাওয়া এবং আসার যে কত মজা তা আমরা এখন অনুভব করি। মকতবের পর আবার দলবদ্ধ হয়ে একটু খেলাধুলা করার পর সময় হয়ে যেত স্কুলের, এরপর চলে যেতাম স্কুলে।
স্কুল থেকে বাড়িতে আসার পর একটু ঘুমানো ছাড়া তো ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। আম্মুর ভয়ে আমরা ঘুমাতে যেতাম, কিন্তু ঘুম আসতো না ভাবতাম কখন আছরের নামাজের আযান পড়বে মাঝেমাঝে দেখা যেত বন্ধুরা জানালার কাছে এসে আস্তে আস্তে ডাকতো কিন্তু আম্মুর ভয়ে যাওয়ার আর সাহস হতো না। আছরের আযান দিল এবার তো মহাখুশি শুরু বিকাল বেলার খেলাধুলা (কানাঁমাচি ভৌ ভৌ, লুকোচুরি, আমপাতা জোড়া জোড়া, জুতো চুরি, ক্রিকেট ফুটবল ইত্যাদি)। এক সাথে পাড়ার সকলে মিলে খেলাধুলার করার মজা এখন আর কোনো কিছুতেই পাই না। সন্ধ্যার পর পরই পড়তে বসা পড়া শেষ করে ঘুমানো এভাবেই কাটতো কৈশোর জীবন। বৃহস্পতিবার আসলে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করতো কারণ এরপরের দিন শুক্রবার। এভাবে আবার শুক্রবার বিকালে মন খারাপ হয়ে যেত কারণ শনিবার থেকে আবার সবকিছু আগের মতো করতে হবে।
আজ জীবনের মাঝে কিশোর সময়ের মজা কোনো কিছুতেই পাই না। মানুষের মুখে একটি কথা শুনা যায়, কৈশোর জীবনের বন্ধু গুলোই নাকি জীবনের সেরা বন্ধু হয় আসলেই তাই। এখন অনেক করে ফিরে পেতে চাই আমাদের কৈশোর কাল কে। কৈশোর কালে কোথাও বেড়াতে গেলে যে আনন্দ পাওয়া যেত সেটা এখন আবার ফিরে পেতে চাই। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটা সময় কৈশোর সময় কারণ তখন আমরা হিংসা, বিদ্বেষ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতাম না। অবশেষে বলতে চাই সোনালী অতীত আবার চাই যা কখনো ভুলব না।
মেলা শেষ
তন্ময় চন্দ্র দাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দীর্ঘ একমাসের বইমেলার সমারোহ গতকাল শেষ হলো।প্রতিদিন নানান মানুষের আগমনে উদ্যান যেন নতুন এক রূপ ধারণ করেছিলো৷ জনশুন্য উদ্যানটাকে আজকে শুষ্ক, বিমর্ষ মনে হয়৷ সারি সারি বইয়ের দোকানের কাঠামোগুলোকে দেখে মনে হয় লম্বাকৃতি কোন প্রাগৈতিহাসিক জীবের কংকাল৷
কয়েক মাসের শীতের শুষ্কতায় সমস্ত গাছপালা, দালানের দেয়াল, রাস্তাঘাটে যেন এক ধুলির পুরু আস্তরণ জমা হয়েছে৷ শীতের শুষ্কতা যেন সমস্ত রস শুষে প্রকৃতিকে এক রুক্ষ আবহ দান করেছে ৷
হাতে দুটো জলের বোতল নিয়ে আইমান দাড়িয়ে দাড়িয়ে শেষ হয়ে যাওয়া মেলার দোকানের কাঠামোগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে৷ প্রতিবছরের এই বইমেলা গৃহহীন, সম্বলহীনদের জন্য উৎসবের মত ৷ এবার পানির বোতল বিক্রি করে আইমান বেশ ভালোরকম পয়সা রোজগার করেছে ৷ তবে ছোট হওয়ায় বড় আকারে ফুলের ব্যাবসা সে করতে পারে না৷ কিছু ফুলের রিং, ফুলের চুড়ি বানিয়ে হাতে ফেরি করে বিক্রি করে৷
এবার মেলায় তার সঙ্গে শ্রী দিদির পরিচয় হয়৷ উদ্যানের গেটের খোলা জায়গাটায় তার প্রথম দেখা হয়েছিলো৷ মেলায় গেটের ফাকা দিকটায় একটা বড় টেবিল রেখে ওরা দুজনে মিলে ফুল বিক্রি করত৷ ও প্রথমে তাদের দেখে অবাক হয়ে যায়৷ ওদের মত ফুটপাথে যারা থাকে শ্রী-দি তো সেরকম না মোটেও৷ সে তো অনেক সুন্দর৷ সে আইমানের মত বাইরেও থাকে না৷ অন্য যত মেয়েদের সঙ্গে সে কথা বলেছে এ তাদের মতো না৷ ওর মনে প্রশ্ন জাগে, এরকম কেউ কি ফুল বিক্রি করে? ও এসবের সমাধান বের করতে পারে না৷
শ্রী দিকে ওর অনেক ভালো লেগে যায়৷ দু-এক দিনের মধ্যে ওদের সঙ্গে আইমানের খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়৷ প্রতিদিন শ্রীদির কাছে গিয়ে তাকে কাজে সাহায্য করা যেন তার রুটিন হয়ে দাড়ায়৷ শ্রী-দি ওকে অনেক আদর করে৷ তাকে দোকানে খেতে নিয়ে যায়৷ আট বছর বয়সী মাতৃহারা আইমানের মনে এ স্নেহভরা সঙ্গ, এরকম আদর একেবারে নতুন মনে হয়৷ তার মনে অন্যরকম এক অনুভূতির ছাপ ফেলে৷ কেউ তো আগে কখনো তার সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি৷ সে যেন নতুন এক আস্হার সন্ধান পায়৷ যত জলদি পারে জলের বোতল বিক্রি করে সে ওদের কাছে চলে যায়৷ বিকাল হতে পুরোটা সন্ধা তাদের সঙ্গে কাটায়৷ তার দৈনিক জীবনে নতুন এক আনন্দের সঞ্চার হয়৷
আইমানের জন্ম হয় এই উদ্যানেই৷ ওর বাবার পরিচয় সে জানে না৷ ওর যখন পাঁচ কি ছয় বৎসর বয়স তখন ওর মা মহামারিতে মারা যায়৷ এই উদ্যানের সমস্তটা নিয়েই তার বাড়ি৷ এখানকার অন্য সম্বলহীন ফুটপাথে বসবাসকারীদের সঙ্গেই সে বড় হয়৷ কখনো ফুল বিক্রি, জলের বোতল বিক্রি সহ আরো নানান উপায়ে অতি কষ্টে তার দিনের খাবারটুকু জোগাড় করতে হয়৷ কখনো জোটে, কখনো জোটেনা৷ কিন্তু কখনো না জুটলে কিছু করার থাকে না৷
সকালের নাস্তা সময় মতো না পেলে সেতো আর চিৎকার করে তার মাকে ডাকতে পারে না৷ তার ক্ষুধার কথা শোনার বা তার অভিযোগের কথা শোনার কেউ নেই এখানে৷ এখানে খাবার জোগান অনিশ্চিত৷ তার দৃঢ় বিশ্বাস তার কথা কেউ একদিন শুনবে৷ সে তার সকল কথা তাকে উজার করে বলবে৷ ছোট্ট হৃদয় কত কল্পনাই না করে, বাস্তবে তার কথা শোনার কেউ নাই৷ সময়ের আবর্তে সে হয়তো বড় হয়ে উঠবে, বেঁচে যাবে কোনভাবে ৷ তবে এরকম জীবন কারই বা কাম্য..? জীবনের অনাদর অবহেলা ক্ষুধা সমস্ত যেন শিশুহৃদয়ে এক গভীর ছাপ ফেলে৷ শুষ্ক মাটিতে এক বিন্দু জল মাটি যেমন তৎক্ষনাৎ শুষে নেয়৷ তেমনি সামান্য স্নেহের পরশ যেন তার কাছে আর সমস্ত কিছুর চেয়ে দামী হয়ে ওঠে৷
যে শিশুহৃয় অনেক দিন ভালোবাসার ছোয়াপায়নি, স্নেহবঞ্চিত এমন হৃদয়ের মর্মবেদনা সম্ভবত একজন মমতাময়ী নারীর দ্বারাই লাঘব সম্ভব৷ কিন্তু এসব সুযোগ সুবিধা বঞ্চিতদের জীবনে এরকম স্নেহ কোন স্হায়ী সমাধান ডেকে আনে না৷ বরং নিশ্ফল আশার সঞ্চার করে৷ তবুও এটুকুই যেন তারা আকড়ে ধরতে চায়৷ সে সেই মমতাময়ীকে প্রাণপনে ধরে রাখতে চায়৷ কিন্তু বিধাতা এদের জীবনের জন্মগত ভাগ্য এরকম করে রাখেনি৷ একদিন শ্রী দিদি দোকান নিয়ে এলোনা৷ এর আগেও একদিন এমন হয়েছে৷ সে ভাবলো পরেরদিন হয়তো আসবে কিন্তু ওরা এলোনা৷ সেই যে ওরা দোকান উঠিয়ে চলে গেলো৷ আর একদিনো ওদের দেখা মিললো না৷
কিন্তু দিদি তো আসতে চেয়েছিলো৷ তাকে বলেও গেছিলো যে, আর কিছুদিন পরে নাকি সে আসবে৷ সে প্রতিদিন ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করে৷ প্রতিদিন রাতে সে ঘুমানোর আগে তারাদের দিকে চেয়ে থেকেছে এবং ভেবেছে কাল বোধহয় ওরা আসবে৷ একথা ভেবে এক অজানা আনন্দে যেন তার বুক ভরে উঠত৷ কিন্তু একদিন, দুদিন, তিনদিন এভাবে পনের দিন কেটে গেলো৷ কিন্তু ওরা এলো না৷ ওর সমস্ত অঙ্কুরিত আশা যেন মরে যেতে থাকলো এবং দেখতে দেখতে মেলা শেষ হয়ে গেলো৷ আর বোধহয় দিদি আসবেনা৷ অভিমানে তার চোখের কোনে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করে উঠলো৷ কার কাছে সে খোজ নেবে৷ দিদি কোথায় থাকে তাতো সে জেনে রাখেনি৷ এ যেন কোন এক শুভ স্বপ্ন, নিদ্রার মধ্যে এসে অল্পক্ষণ স্হায়ী হলো৷
আইমান হেটে ঐদিকটায় গেলো যেখানে ওরা ফুল বিক্রি করতো৷ সে সেই জামগাছটার নিচে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো যেখানে ওরা টেবিলটা বসিয়েছিলো৷ এরপর ডানদিকের সরু কনক্রিটের নতুন তৈরি রাস্তাটা দিয়ে ফাকা মাঠের দিকে যেতে আরম্ভ করলো৷ কিছুদূর সামনে এগিয়ে সেখানে একটা বটগাছ পরে৷ চিকন রাস্তাটার ঠিক মাঝখানে৷ রাস্তাটা ওখানে গিয়ে ঠেকেছে৷
হঠাৎ বটগাছটার পেছন হতে একটা চেনা মুখ বেরিয়ে আসলো৷
বাম কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মেরুন শাড়ী পরা সেই শ্রী- দি৷ হেটে এদিকেই এগিয়ে আসছে৷
সে দূর থেকে বললো, এই ছোটু, কেমন আছিস৷ আইমান যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না৷ হাতের দুটো বোতল ফেলে দৌড়ে গিয়ে শ্রী-দি কে জড়িয়ে ধরলো৷ আবার সেই বহুল আকাঙ্খিত স্নেহাস্পর্শ৷ এতদিনের সমস্ত জমানো অভিমান তরল হয়ে তার গাল হয়ে বেয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো।
বাস্তবতা
খন্দকার রাদিবা রাইতা
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ
কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। ঘড়ির কাঁটা ৪টা ছুঁইছুঁই। ঢাকার মিরপুরের বস্তির এক ঘরে ঘুমাচ্ছে লামিয়া ও তার ভাই লিয়ান। ভাঙা চাল দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরের ভিতর। শীতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে অ্যালার্ম বেজে উঠে লামিয়ার ছোট্ট ফোনটাতে। ঘুম থেকে উঠে পড়ে সে। পাতলা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। শীতে কাঁপছে সে। চারদিক অন্ধকার, কুয়াশাচ্ছন্ন। দূর পর্যন্ত কিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বলছে। রাস্তায় লোকজন নেই। ফুটপাতে কুকুর শুয়ে আছে। গা থমথমে পরিবেশ। ভয় লাগতে থাকে লামিয়ার। কিন্তু সাহস করে হেঁটে চলে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজের আজ তার প্রথম দিন। দ্রুত হেঁটে চলে লামিয়া।
তবুও পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে যায়। ঝাড়ু হাতে চলে যায় সে রাস্তা ঝাড়ু দিতে। কাজ শেষ করতে করতে সকাল হয়ে যায়। কুয়াশায় ঢাকা আকাশে উঁকি দিতে থাকে ভোরের সূর্য। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা শুরু হয়। ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের মা-বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে থাকে। তাদের দেখে লামিয়ারও ইচ্ছা হয় তার ছোট ভাইকে পড়ালেখা শিখাবে। সেও একদিন এভাবে স্কুলে যাবে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে যায় লামিয়া। আজকে কাজ করে পুরো ১০০ টাকা মুজুরি পেয়েছে সে। অনেকদিন পর তার ভাইকে ভাল কিছু খাওয়াতে পারবে। খাবার কিনতে যায় রাস্তার পাশের এক হোটেলে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এই বড়লোকদের মাঝে এই ছেঁড়া জামাকাপড় পরা লামিয়াকে যেন কারও চোখে পড়ে না। উপায় না পেয়ে আরেক হোটেলে যায় সে।
কিন্তু আবার সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তার দারিদ্রতা। লামিয়ার ছেঁড়া ময়লা কাপড় দেখে হোটেলের ম্যানেজার বলে, “এটা ভদ্রলোকের জায়গা, তদের মতো ফকিরদের না। ভাগ এখান থেকে।” মনভার করে লামিয়া চলে যায় সেখান থেকেও। শেষ পর্যন্ত তাদের বস্তির পাশের এক হোটেল থেকে খাবার কিনে সে বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি এসে দেখে তার ছোট ভাই একটা খাতা কলম নিয়ে দাগাদাগি করছে। কত্থেকে যেন গতকাল কুঁড়িয়ে এনেছিল সে। লামিয়াকে দেখে দৌঁড়ে আসে লিয়ান। তার মিষ্টি হাসি মাখা মুখ নিয়ে বলে, “দেখো আপু আমি এগুলা লিখছি, সুন্দর হইছে না?” ভাইকে সান্তনা দেওার জন্য লিয়ানের কাঁধে হাত রেখে মুচকি হাসে লামিয়া। তারপর ভাইবোন দুইজনে মিলে খেতে বসে। এমন সময় আসে বাড়ির মালিক জামিল মিয়া। লাথি মেরে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে লামিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চার মাস ধরে আমার ঘরের ভাড়া দিস নাই তোরা। আমার টাকা মাইরা দিয়া অসভ্যরা খাইতাছে। আমার বাড়ি ছাইড়া অহনই বের হইয়া যা ।”
তারপর তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা তার দুই চাকরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ওই, ওগোর বের কর এখান থেইকা।” লামিয়া হাঁটু গেড়ে তার দুই হাত জোড় করে বলে, “সাহেব, আমাগোর বের কইরেন না। আমি খুব দ্রুত আপনার ভাড়া দিয়া দিমু।” জামিল মিয়া লামিয়ার কথা শুনে মুখ বাঁকিয়ে বলেন, “তোগোর মতো ছোটলোক আমি কম দেখিনি জীবনেত।” জামিল মিয়া মেঝেতে রাখা খাবার প্লেটে লাথি মেরে বলেন, “যা, বের হ আমার বাড়ি থেইকা।” জামিল মিয়ার হাত–পা জড়িয়ে ধরে অনেক অনুরোধ করার পরও এই ধনী মানুষটার নিষ্ঠুরতার কাছে হেরে গেলো এই হতদরিদ্র দুই ভাই-বোন। রাস্তায় আসে পড়ে তারা। লিয়ানকে নিয়ে লামিয়া এখন কোথায় যাবে, কি করবে জানে না। তার মনে হতে থাকে যদি সেই দিন তার মা তাদের ছেড়ে আরেকজনের সাথে চলে না যেত, তার অসহায় বাবাকে যদি গ্রামের প্রভাবশালীরা নির্মম ভাবে হত্যা না করতো তবে হয়তোবা তাকে আর ছোট্ট লিয়ানকে এই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখিন হওয়া লাগতো না।
কেটে যায় এক মাস। শীত এখন আরও জেঁকে বসেছে। খাদ্যাভাব ও গরম কাপড়ের অভাবে দিন কাটাচ্ছে লামিয়া ও লিয়ান। অনেক মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছে সে। কিন্তু এই ঢাকা শহরে তাকে একটি কম্বল দেওয়ার মতো স্বাবলম্বী মানুষও যেন নেই। দিনে ১০০ টাকায় তাদের খাবারের চাহিদাও মিটে না। বেশ কিছু দিন ধরে জ্বরে ভুগছে লিয়ান।
যেখানে তারা তিন বেলার খাবারই পায় না সেখানে চিকিৎসা তো বিলাসিতার স্বরূপ। একদিন রাতে কাজ খুঁজে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ফিরছিল লামিয়া। বস্তি থেকে বের করে দেওয়ার পর সেখানেই ঠাই হয়েছে তাদের। এসে দেখে জ্বরে লিয়ানের গা পুড়ে যাচ্ছে, অজ্ঞান হয়ে গেছে সে। তাড়াতাড়ি লামিয়া লিয়ানকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসে। ডাক্তার বলেন লিয়ানের ডেঙ্গু হয়েছে। অবস্থা খুবই খারাপ। এখনই রক্ত না দিলে বাঁচান যাবে না লিয়ানকে। লামিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। লামিয়া আর লিয়ানের রক্তের গ্রুপ আলাদা। তাই সেও রক্ত দিতে পারবে না। ব্লাড ব্যাংক থেকে ব্লাড কিনার সামর্থ্য ও তার নেই। কোন উপায় না পেয়ে হতাশ হয়ে যায় লামিয়া। তার মনে হয় লিয়ানকে আর বাঁচাতে পারবে না। ভাইয়ের কাছে যায় সে। তাকে দেখে লিয়ান বলে, “আপু, আমার খুব বিরিয়ানি খাইতে ইচ্ছা করতাছে। আমি ভালা হয়া গেলে আমারে খাওয়াবা?” লামিয়া বলে, “হ, খাওয়ামু।” মরণাপন্ন ভাইকে দেখে চোখে পানি চলে আসে বোনের। লামিয়া ঠিক করে যে করেই হোক লিয়ানকে বাঁচাবেই।
শেষ পর্যন্ত অসৎ উপায় অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নেয় লামিয়া। রাস্তার ভিড়ের মাঝে এক মহিলার ব্যাগ থেকে কিছু টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় লামিয়া। সেই মহিলার লোকজন ও কিছু পথচারী লামিয়াকে ধরার জন্য ধাওয়া করে। বাঁচতে প্রাণপণে ছুঁটতে থাকে সে। এমন সময় দ্রুত বেগে চলতে থাকা একটি গাড়ি ধাক্কা দেয় তাকে। ছিটকে পড়ে লামিয়া। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে, ভেসে উঠে অসুস্থ লিয়ান এর মুখটা। মনে হতে থাকে এটাই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে তার মত হতদরিদ্রিদের কোন স্থান নেই। হয়ত এটাই গরিবের জীবনের বাস্তবতা। তবুও লামিয়া বাঁচতে চায়, তার প্রিয় ছোট্ট ভাইটার জন্য!
রঙ বদলে বিষ
তহিসন আহমেদ তনয়
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
“মিস্টার তূর্য, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট! মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে আপনি গ্রেফতার।” হুঙ্কারের সাথে বলে উঠলেন জনৈক পুলিশ অফিসার। দেখুন, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।আমাদের ছেলে এমন কাজ করতে পারেনা। আমাদের কাছে আপনার ছেলের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ আছে। আপনি কেমন বাবা যে নিজের ছেলে এতকিছু করে বেড়াচ্ছে আর আপনি কোনো খোঁজখবরই রাখেননা? সন্তান জন্ম দিয়ে ছেড়ে দিলেই হয়না। তাকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে হয়।
- বাবা, মা তোমরা কিছু করো। ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে যে…
- আপু, তোরা বাবাকে বোঝা না…
- ভাইয়া, অন্তত তুমিও আমাকে দূরে ঠেলে দিওনা সবার মতো। প্লিজ কিছু একটা করো!
“লিভ মি…” নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ী। তূর্য তরফদার। এদিকে রাস্তার সবার সামনে দিয়ে টানতে টানতে তাকে গাড়িতে উঠাচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
অন্ধকার জেলের ভেতর বসে আছে তূর্য। অনেকদিন হলো বাইরের আলো দেখতে পায়না। অথচ একটিবারের জন্যও পরিবারের কেউ দেখতে আসেনি তাকে। এমনকি তার দরদি মা পর্যন্তও না। এক অসহ জ্বালায় ছটফট করছে সে। পুরো শরীরে কি যেন এক বিষের ব্যাথা ছড়িয়ে পড়েছে স্বাধীনভাবে। ইনজেকশনের সুঁচের মতো চিমটি কেটে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বিষ যন্ত্রণার এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে। অতঃপর সাদা কালো তার কল্পনার রাজ্যে কিছু দৃশ্য প্রতিভাত হতে লাগলো ধারাবাহিকভাবে।
“এক প্রাণোচ্ছল আর স্বপ্নবাজ তরুণের প্রতিমূর্তি ভেসে উঠেছে সেখানে। যার দুচোখ জুড়ে শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন। স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশের শীর্ষ মেধাবীদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাওয়া। পেলোও তাই। বাবা মায়ের আশীর্বাদে নতুন জীবন শুরু হলো তার। কত আশা তাদের ছেলেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে তাদের ছেলে, একদিন খুব বড় ম্যাজিস্ট্রেট হবে। পুরো পরিবারে এক খুশির বন্যা বয়ে গেছে তাকে নিয়ে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাদের ভদ্র শান্ত ছেলেটা কেমন যেন পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে উঠতে লাগলো। বন্ধুদের সাথে বেশি বেশি ঘোরাফেরা করতে শুরু করলো। বাবার পাঠানো কষ্টের টাকা দিয়ে বড়লোক বন্ধুদের সাথে পার্টি করে। প্রথম প্রথম যদিও তার কাছে এগুলো স্বাভাবিক বলে মনে হতোনা কিন্তু বন্ধু সংকরের আশ্বাসে সে বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শুরু করলো। বড়লোক বাবার ছেলে বন্ধু সংকর ডেটে যায়, ড্রিংকস করে, ইনজেকশনের মাধ্যমে বডিতে কি যেন পুশ করে। বিষয়গুলো প্রথম প্রথম তার খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু বন্ধুর যুক্তি এগুলো খুব স্বাভাবিক বিষয় ভার্সিটির স্টুডেন্টদের জন্য, পুরুষ মানুষের স্মার্টনেস, সারাজীবন কি ক্ষ্যাতমার্কা হয়েই থাকবি? তাছাড়া লাইফটাকে উপভোগ করতে হয়। বন্ধুর প্ররোচনায় এক পর্যায়ে সেও নেশাগ্রস্ত হতে থাকে। যে ছেলে কখনো কোনো মেয়ের হাত ধরারই সাহস পায়নি আজ সেই ছেলের কাছে সবকিছু সাধারণ ব্যাপার। বড়লোক বন্ধু সংকরের সাহচর্যে যেন রাতারাতি সবকিছুতেই দক্ষ হয়ে উঠেছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগস গ্রহন করছে। মাদকাসক্ত থেকে পুরোদস্তুর একজন মাদক ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত। কল্পনার সেই ছেলেটি আর কেউ নয়, তূর্য নিজেই।
কারাগার জীবনের ৪ বছর, ১১ মাস, ২৩ দিন। বিগত চার বছরে অনেককিছুই পাল্টেছে। নেশার ঘোরও কেটেছে তার। অতীত হিসেবে ফেলে আসা জীবনের রঙ্গিন দিনগুলো খুব মনে পড়ছে আজ। চোখে ভেসে উঠছে বাবা মায়ের মুখচ্ছবি, মমতাময়ী মায়ের হাসিভরা মুখটি। কতদিন হলো তাঁর হাতের রান্না খাওয়া হয়না। কে জানে আপুরা কেমন আছে।
আচ্ছা, ছোট আপুর বিয়েটা হয়ে গেছে কি? খুব বাড়ি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ। এই আর তো মাত্র সাতটা দিন। এরপরই তো ছাড়া পেয়ে যাবো। আচ্ছা, বাবা আমাকে ক্ষমা করবেন তো? কেন করবেননা? অবশ্যই করবেন। মা বলতেন যে বাবা-মায়ের দরজা সন্তানদের জন্য সবসময় খোলা থাকে। এইবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। নতুন করে জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়া যাবে। এইভেবে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলে নেয় সে।
সাতদিন পর,
- সেন্ট্রি, লকাপ খুলে দাও! মিস্টার তূর্য, আজ থেকে আপনি মুক্ত।
পুলিশ সুপারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তূর্য বেরিয়ে আসলো সেখান থেকে। হাঁটতে লাগলো বাড়ির পথ বরাবর। আজ কতগুলো বছর পর সবার সাথে দেখা হবে!
- কিরে, তূর্য নাকি?
- আরেহ তুষার, কেমন আছিস (সহাস্যে)? কতদিন বাদে দেখা হলো, কোথায় যাচ্ছিস?
- ভালো আছি। তুই ঠিক আছিস তো? আর আমি তো অফিস যাচ্ছি। তুই কোথায় যাচ্ছিস আর করছিসটা কি এখন?
- তোর চাকরি হয়েছে?
- হ্যাঁ! বিয়েও করে নিয়েছি। তুই তো গ্র্যাজুয়েশনটাও কম্প্লিট করিস নি। তা তোর ড্রাগ ব্যবসা আছে এখনও? বলেই হাসতে হাসতে চলে গেলো তুষার।
বিকেল হতে হতে বাড়িতে পৌঁছে গেলো তূর্য। কলিং বেল প্রেস করার পর দরজা খুলে কেউ একজন কে আপনি? কাকে চাই?
- কাকে চাই মানে, আপনি কে? এটা তো আমাদের বাড়ি।
- মেয়াদোত্তীর্ণ গাঁজা সেবন করেছেন আপনি? বাড়িটা কার তা দেয়ালে সাঁটানো হোল্ডিং কার্ডেই দেখে নিন। যত্তসব নেশাখোর কোত্থেকে আসে!
হোল্ডিং কার্ডে বাড়ির মালিকের নাম দেখে চমকে উঠলো তূর্য। জনৈক লোককে উদ্দেশ্য করে অনুরোধের স্বরে বলতে যাচ্ছে এক্সকিউজ মি! আমার কথাটা শুনুন…..
বলতে বলতে মুখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। পেছন থেকে কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভূত হলো। ফিরে তাকাতেই চোখে ভেসে উঠলো তূর্যের বহুল চেনা পরিচিত একটি মুখ।
- জমিলা খালা, কেমন আছেন আপনি? আচ্ছা, আমাদের বাড়িতে এরা কারা জানেন? আর আমার পরিবারই বা কোথায়?
- তারা তো সেই পাঁচ বছর আগেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
- কি?
প্রত্যুত্তরে ফের বলে উঠলো তূর্য, কোথায় গেছেন তারা?
হাত ধরে তূর্যকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন জমিলা খালা। তূর্য কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা।
- কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? উত্তর দিচ্ছেন না কেন?
খালা কোনোরূপ উত্তর না দিয়েই টানতে টানতে একটি কবরস্থানের সামনে এনে দাঁড় করালেন তাকে। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন এখানেই থাকেন তারা।
তূর্যের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো।
সেদিনের সে ঘটনার পরপরই তাৎক্ষণিক হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তূর্যের বাবা। স্বামী সন্তানের শোকে মারা যান স্ত্রীও। এলাকায় একঘরে হয়ে যায় পুরো পরিবার। রাস্তাঘাটে বেরুলেই বাজে মন্তব্য শুনতে হচ্ছিলো। তূর্যের ব্যাকগ্রাউন্ড জানার পর তার ছোট আপির বিয়েটা ভেঙে যায়। অন্যদিকে শ্বাশুড়ির মৃত্যুর আগেই সুকৌশলে বাড়িটা আত্মসাৎ করে নেয় তার দুলাভাই, বোনের সাথে সব সম্পর্কও ছিন্ন করে দেয়। দুঃখে কষ্টে উপায়ন্তর না দেখে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় দুইবোন।
বাবা মায়ের কবরের সামনে অবশ হাঁটুগুলো গেড়ে বসে পড়লো তূর্য।
- বাবা, পারলে আমাকে মাফ করে দিও। আমি তোমার সম্মান আর জীবন দুটোই শেষ করে দিয়েছি।
- মা, তুমি তো সেদিনই মরে গেছো যেদিন আসামী তূর্যকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলো পুলিশ। তোমার বাঁচার অধিকার আমিই কেড়ে নিয়েছি।
- আর আপুরা, এতোটা স্বার্থপর হতে পারলি তোরা? ছোটবেলায় তো খুব বলতি সবসময় আগলে রাখবি আমাকে অথচ আজ নিজেরাই পালিয়ে গেলি ছোটবেলায় দেখিয়ে দেয়া আকাশের তারাদের রাজ্যে?
শেষ নামটি মাথায় আসামাত্রই রাগ চড়ে উঠলো তার। ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মস্তিষ্কে ভেসে আসলো পুরোনো একটা সীন “আমি তোমাকে শালা মনে করিনা তূর্য, নিজের ছোট ভাই বলে মনে করি। আর আমার কাছে এটা কোনো শ্বশুরবাড়ি নয়, আমার নিজেরই বাড়ি, নিজেরই পরিবার। জীবনে যত যাই কিছু হয়ে যাক না কেন, তোমার ভাইয়া তোমাদের পাশেই থাকবে।”
“আমারই করা পাপের বিষে ধ্বংস হয়ে গেছে আমার পুরো পরিবার। ছদ্মবেশী বিশ্বাসঘাতকটাকে শেষ করে দেবার মাধ্যমে আমার চূড়ান্ত কর্মও শেষ। এবার আমার ফেরার পালা।”
- স্যার, মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তাটায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।
- নো নিড টু ইনভেস্টিগেইট। ইট’স নট এ্যান এক্সিডেন্ট, ইট’স অ্যা সেল্ফ মার্ডার!
ক্ষমা
এম মাজিদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
কাজী নজরুল মহোদয় তার এক লেখায় লিখেছিলেন – “ক্ষমা কর এ বাঙালী কে, ভিক্ষা দাও! খোদা ভিক্ষা দাও! এ জাতির একটা যোগ্য নেতা ভিক্ষা দাও! আমাদের এমন এক নেতা দাও, যে বলবে আমি আমার নয়, আমি দেশের। আমি আজ ঘরের নয়, আমি পরের।”
নেতার অভাব নেই, তবে পরের নয়, ঘরের। বাঙালীর তকদিরে ভিক্ষার থলেও শূন্য রয়ে যায়। সেই নেতার জন্ম আর এই ধরায় হল না, যাকে দেখে যেন সবাই বলে, এতদিনের পর একটা ছেলের মতো বেটাছেলে দেখলাম।
নচিকেতা দা তার গানের ভাষায় বলেন- “প্রতি দিন চুরি যায় মুল্যবোধের সোনা, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের চেতনা। সংঘাত – প্রতিঘাত দেয়ালে দেয়ালে আঁকা, তবু চুরি যায় প্রতিবাদের ভাষা।”
সত্য যে, বেকার- বেহায়া বাসীর স্বপ্ন গুলো প্রতি দিনই চুরি হচ্ছে, দেখতে দূরবীনের দরকার হবে না। দাদু, তুমরা চশমাটা পরিষ্কার করে নেও, দেখতে পাবে, মিথ্যা নয়। আপাত স্ববিরোধী সত্য মেনেই মানুষের জীবন থেকে কিট এর জীবন যাপন শুরু করেছি। শুনি যারা স্থূল বেতন পেয়ে ঢাকায় জব করেন, তারা ঢাকাতে থাকেন বলে গণ্য হন, যারা শীর্ণকায় বেতন নিয়ে আধা বা পুরা বেকার তারা ঢাকায় পড়ে আছে বলে গণ্য হন। এরা নাকি দিনে সাড়ে তেয়িশ ঘন্টা মানুষ হিসেবে আমার অপরাধবোধ, নামক রোগে ভোগে। অথচ এ বাঙালির নাকি দেড়শ বছর শুধু লাঠি দিয়ে স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন্য রাখার ঐতিহ্য রয়েছে।
সেদিন নিউজে দেখলাম ব্যাংকের এমডি ৫ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। ঐ টাকায় ৫ হাজার বেকারের জীবিকার সংস্থান হতে পারতো। আজ দুদক, সামরিক সকল বাহিনী দিয়েও দেশের সম্পদ রক্ষা হল না। কে যেন বলল দুদক নাকি চোর ধরবার জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করে ঐ টা নাকি শুধু ছেচড়া চোর ধরতে পারে!
তাদের কৃতকর্ম দেখে আমার ইতালির এক রাজার পাখি পালনের করণীয় ব্যক্তি বর্গের বুদ্ধিমত্তার কথা মনে পড়ে গেল। ইতালির রাজা পাখি পালনের জন্য একটা বিশেষজ্ঞ দল গঠন করলেন। দলটি একটি বিশাল এলাকা নিয়ে প্রাচীর দিয়ে পাখিদের ঐ এলাকায় পালনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। পাখি গুলো কমিটির বেহায়া নাক কাটা বুদ্ধির ভুলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ কথা শুনে রাজা দলটিকে ধমক দিয়ে ব্যর্থতার কারণ বের করতে বলল। কমিটির সদস্যগণ রাজার অর্থে চা নাস্তার ছয়লাব করে, ঊনষাট কোটি চৌষট্টি লাখ রিপোর্ট পেশ করে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, ঐ প্রাচীর গুলো যথেষ্ট উচ্চ ছিলো না!
যে কারণে পাখি গুলো পালাতে পেরেছে। এভাবেই পাখি গুলো অন্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছে, কেউ বেগম পাড়ায়, কেউ বা সকিনা পাড়ায়। দেশপ্রেমিক দেশবাসি চূসিতেছে, কি চূসিতেছে তা জনাব/জনাবা পাঠক মহোদয়ের উপর স্বাধীনতা দিয়ে দিলাম, আশা করি মহোদয়গণ তার মনের উৎকর্ষতা অনুযায়ী বসিয়ে নিবেন।
বাংলা প্রবাদে আছে –
“গড়ন ভাঙিতে পার আছে কত খল
ভাঙিয়া গড়িতে পারে যে জন বিরল”
আমার কেন জানি মনে হয়, সম্পদ তৈরি করতে সমস্যা বাঙালির নয়, রক্ষানাবেক্ষণেই বাঙালির সমস্যা। এ বাঙালির আর প্রয়োজন নেই এমন নেতার, যিনি সমাধানহীন সমস্যার দুর্বোধ্য ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, যিনি সারা দুনিয়াকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখান অথচ নিজের খাসলত আর কু-উদ্দেশ্য এক চুলও পরিবর্তন করেন না। এই দেশটিতে সকলের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে, কিন্তু সকলের লোভ মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ নেই। দূর্নীতিগ্রস্ত অর্থনীতি, ডিগ্রীধারী ভোগবিলাসি নেতা দিয়ে রাষ্ট্রের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত বিছিয়ে দিলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্য কখনই বদলাবে না। লজ্জিত হওয়া থেকে বাঁচাও প্রভু, যোগ্য নেতা ভিক্ষা দাও।
“টিলাতে মোর ঘর, নেই প্রতিবেশী
হাঁড়িতে মোর নেই ভাত, নিতি আবেশী (ক্ষুধা)” – (চর্যাপদ)
ক্ষমতার পালাবদলঃ দাবা
আনিকা তাবাসসুম ওহী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
সারা পৃথিবী জুড়েই দাবা একটি জনপ্রিয় খেলা। শুধু জনপ্রিয়ই নয় বরং রাজকীয়ও বটে। প্রতি বছর দাবাকে ঘিরে টুর্নামেন্ট সহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। আধুনিকতার সাথে সাথে দাবা খেলাও আধুনিক হয়েছে, ভার্চুয়ালি অনেক কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। সেই সাথে এর পূর্বের ইতিহাসের সাথে বর্তমানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও এসেছে। তবে এর মধ্যে দাবার সবচেয়ে চমকপ্রদ পরিবর্তনটা হয়েছিল ‘রানীর’।
দাবার প্রথম উদ্ভাবন হয়েছিল ভারতে, ষোল শতকের কাছাকাছি সময়ে। সেসময় এটা ‘চতুরঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল। একটা যুদ্ধকে চৌষট্টিটি সাদাকালো ঘরের মধ্যে নিয়ে আসা আসলেই চমৎকার একটি উদ্ভাবন। ফলে এই খেলা খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দাবাকে ‘রাজার খেলা’ বলা হলেও চালের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালি গুটি কিন্তু রানী। তবে মজার বিষয় হচ্ছে দাবা খেলা ইউরোপে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দাবা বোর্ড এ রানী বলে কিছু ছিল না। রানীর বদলে ছিল রাজার পরামর্শক বা মন্ত্রী। এবং এই মন্ত্রী ছিল দাবা বোর্ডের সবচেয়ে দুর্বল গুটি যে শুধুমাত্র কোনাকোনিভাবে যেকোনো দিকে মাত্র একঘর যেতে পারত।
পনেরো শতকে এসে ইতিহাস কিছুটা মোড় নেয়। ভারতবর্ষের সাথে বানিজ্যের সুবাদে আরবরা দাবার সাথে পরিচিত হয় এবং পরবর্তীতে তারা এই খেলা স্পেনে নিয়ে যায়। সেসময় স্পেনের রানী ছিলেন ইসাবেলা। রানী ইসাবেলা তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের জন্য ‘আয়রন কুইন’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৪৬৯ সালে, ক্যাস্টিলের ইসাবেলা আরাগনের দ্বিতীয় ফার্ডিনান্ডকে বিয়ে করেন। কাস্টিল ছিল স্পেনের একটি বড় অংশ। সেসময় তাদের বিবাহপূর্ব একটি চুক্তি হয়েছিল। সেটা হল, রানী ইসাবেলা ক্যাস্টিলের মুকুট ধরে রাখবে এবং এটি আলাদাভাবে শাসন করবে। ইতিহাসবিদদের মতে, ক্ষমতার দিক থেকে রানী ইসাবেলা তার স্বামী ফার্ডিনান্ডের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন, কিন্তু একই সাথে কূটনৈতিক দিক থেকে রাজা ছিলেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয় এর প্রভাব দাবার উপরেও পরেছিল। বর্তমান দাবার নিয়মকানুন গুলো লক্ষ্য করলেও বোঝা যায় যে এই ধারনা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত।
দাবা খেলা ইউরোপীয় দেশগুলোতে স্থানান্তরের সময় এর নিয়মে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। ধারণা করা হয়, ইউরোপে দাবাকে জনপ্রিয় করে তুলতেই বানিজ্যক এবং রাজনৈতিক কিছু কৌশল গ্রহন করা হয়। ফলে দাবা খেলায় নারী চরিত্রের আগমন ঘটে। শুধু তাই নয়, দাবার সবচেয়ে দুর্বল গুটি মন্ত্রীকে সরিয়ে তার পরিবর্তে রানীকে বসানো হয় এবং সেই সাথে উদ্ভাবন হয় আরো নতুন নতুন চাল এবং কৌশল। পরিশেষে এই রানী হয়ে ওঠে দাবার সবচেয়ে শক্তিশালী গুটি।
বর্ণমালার কৌতুহল
তাসমিয়াহ তাবাসসুম অপ্সরা
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, আজিমপুর শাখা, ঢাকা
ছোট্ট একটি কৌতুহলী মেয়ে বর্ণমালা। তার বয়স এখন হয়তো ৮ বছর হবে। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সব বিষয়ে তার অনেক কৌতুহল। সে বই পড়তে খুব পছন্দ করে। একদিন বই রাখার আলমারিটা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে বই দেখতে গিয়ে খেয়াল করলো, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে একটি বই। মাতৃভাষা দিবসের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানত না সে। তাই সে ভাবলো এ ব্যাপারে তার মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করবে। প্রথমেই বলেছি বর্ণমালা অনেক কৌতুহলী মেয়ে। কৌতুহল নিয়ে সে তার মায়ের কাছে মাতৃভাষা দিবসের কাহিনী শুনছে।
তার মা তাকে বলছেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছিল। সেটিই ছিল ভাষা আন্দোলন। বর্ণমালা তখন মাকে জিজ্ঞেস করলো মা, তাহলে বাংলার আগে আমাদের রাষ্ট্রভাষা কি ছিল? তার মা বললেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদের বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী, নানান রকম অপকৌশলে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করত। এরই ধারাবাহিকতায় উর্দুকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা করা হয়।
কিন্তু বাংলা তো আমাদের প্রাণের ভাষা, আমাদের মুখের ভাষা। এই ভাষাকে রক্ষা করার জন্য সেই সময় ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ মানুষসহ পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনে অনেকেই অংশগ্রহন করে ও বেশ কয়েক জন শহীদ হয়েছেন। তাঁদের অনেকের লাশ গুম করে ফেলার কারণে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৫-৬ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন আবদুস সালাম, রফিক উদ্দীন আহমদ, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, শফিউর রহমান।
তার মা আরও বললেন, আমি এখন যাদের নাম বললাম, তাঁদের শহীদ বলতে হয়। যেমন সবার নামের আগে শহীদ আবদুস সালাম, শহীদ রফিকউদ্দীন আহমদ। বড় হও, শহীদদের ব্যাপারে, শহীদ দিবসের ব্যাপারে তুমি অনেক কিছু জানতে পারবে।
এমন সময় বর্ণমালার বাবা ঘরে আসলেন আর জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, তোমরা কী নিয়ে কথা বলছো? বর্ণমালা বাবাকে বলল, বাবা, মা আমাকে শহীদ দিবস এর গল্প শোনাচ্ছে। বাবা বললেন, শহীদ দিবস আসতে তো আর বেশি দেরি নাই। আগামী মাসেই তো শহীদ দিবস! বর্ণমালা তখন মাকে জিজ্ঞেস করলো, “মা, তোমরা শহীদ দিবসে শহীদ মিনারে ফুল দাও কেন?” মা তখন বললেন, শহীদ দিবসে আমরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে ফুল দিই। বর্ণমালা তখন বলল, এবার ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনে তোমরা আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের সাথে? বাবা বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই। তুমিও আমাদের সাথে যাবে এবার। তবে তোমাকে কিন্তু অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে। পারবে তো উঠতে? বর্ণমালা তখন একটু ভয় পেয়ে গেল। কারণ সে এর আগে এত ভোরে ঘুম থেকে উঠেনি। সে জিজ্ঞেস করল, ভোরে??? মা তখন বললেন, হ্যাঁ, ভোরে উঠতে হবে। সমস্যা নেই, তুমি আগে আগে ঘুমিয়ে পড়লে পরের ভোরে উঠতে পারবে। এই দিনটি কিন্তু আমাদের কাছে অনেক গৌরবময় দিন! বাবা বললেন, হ্যাঁ। বাবা বর্ণমালাকে বললেন, জানো, ফেব্রুয়ারি মাসে পলাশ ফুল ফোটে। অনেক সুন্দর ফুল। সে তখন বলল, পলাশ ফুল আমার খুব পছন্দ। মা তখন বললেন, আচ্ছা আমি যখন ভোর বেলা ফুল কুড়াবো, তখন তোমার জন্য পলাশ ফুল নিয়ে আসবো। এখন যাও। ঘুমিয়ে পড়ো, অনেক গল্প হলো। বাবা বললেন, হ্যাঁ, আর অনেক রাতও হয়েছে। সকালে তো আবার স্কুলে যেতে হবে। বর্ণমালা তখন বাবা-মাকে শুভরাত্রি বলে ঘুমাতে গেল। এদিকে সে তো খুব খুশি! তারপর বিছানায় শুয়ে ভাবলো, ইশ! কবে যে শহীদ দিবস আসবে! তখন থেকে সে শুধু অপেক্ষা করে কবে শহীদ দিবস আসবে আর সে শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ফুল দিবে।
অপূর্ণতা
মিস্ ইসরাত আরা
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দরজায় কে যেন এসেছে ডাকছে বারবার। কেউ দরজা খোলার সাহস পাচ্ছে না মনে হয়। আমার নিজেরই তো ভয় করছে। কিছুক্ষণ পর বাবা দরজার সামনে গিয়ে বলতে লাগলো, “কে আপনি, পরিচয় বলুন”। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলল, “আমি রহমত”। তখন বাবার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে কে এসেছে, তাড়াতাড়ি দরজা খুলল। দরজার বড় বড় দুটো ছিটকিনি খুলতে একটু সময় তো লাগেই। বাবা বলল, আরে রহমত তুমি! তাড়াতাড়ি ভিতরে এসো, এই পরিস্থিতিতে বাহিরে থাকা ঠিক নয়। রহমত কাকু আমার বাবার সাথে চাকরি করতেন একই স্কুলে। কিন্তু আজ ৬ মাস হল কাকু আর স্কুলে যাচ্ছেনা পড়াতে। কাকু কি যেন একটা কাজে যোগ দিয়েছে সব সময় তার সাথে আমাদের আর দেখা হয় না। আগে রোজ সন্ধ্যায় কাকু আমাদের বাড়ি আসত চা খেতে আর কাকুর কাছে কত রকম গল্প শুনতাম। কাকু বলতো একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে তখন আমরা নতুন করে বাঁচতে শিখব। এসব কথার কোনোটির আমি মানে বুঝতাম না। সব কথাই যেন আমার মাথার উপর দিয়ে যেত। আজ সবই বুঝি!
কাকুকে মা চা দিল। বাবা কাকু কে বলল, “আজ তিন দিন ধরে কি বৃষ্টি! স্কুলে যেতে পারিনি। স্কুলে যাওয়ার পথের মাঠ ভর্তি পানি। কি জানি ক্লাসরুমে পানি দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে কিনা। যাই হোক তোমার কথা বল, কেমন আছো? কি অবস্থা এখন”? শফিক ভাই আমি ভালো আছি কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। এই বৃষ্টিতেই সুযোগ পেলাম বের হয়ে আসার। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তো তুমি আছো কোথায় এখন? আমি আছি আরো পঞ্চাশ জনের সাথে ওই যে নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যেই আমাদের ক্যাম্প। কিন্তু শফিক ভাই দিন দিন আমাদের লোকসংখ্যা কমে যাচ্ছে। মিলিটারিদের হাতে অনেকেই ধরা পরছে। কখন কি হয়, বলা মুশকিল। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
মা এসেছে কাকুকে বললো, “আসেন, একটু ভাত খেয়ে নিন।” কাকু বললো, “সময় নেই এখন যেতে হবে।” বাবাও অনেক বার বললো কাকু রাজি হলো না। তখন বাবা বললো, “আচ্ছা, কাজের কথায় আসি তাহলে।” কাকু খুব মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শোনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবা বললো, “তোমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। চারোদিকে যেই পরিস্থিতি, শত্রু মহলদের কাছে ঠিকানা পৌঁছাতে সময় লাগবে না।” কাকু অনেক আতঙ্কিত হয়ে বললো, “তা শফিকভাই, ওরা এখন কোথায় ক্যাম্প করেছে?” “স্কুল থেকে ২০ মিনিট হেটে গেলে যে বড় মাঠ চোখে পড়ে, সেখানে”, বাবা বললো। সেখানে কেউ গেলেই মিলিটারির গুলির শিকার হতে হয়। আজ তাদের জন্য পূর্ব পাড়ার একজন ছাত্রও স্কুলে আসতে পারে নাই। স্কুলে ছাত্র অর্ধেকের চেয়ে কমে যাচ্ছে। কাকু দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো, “আগেতো জান তার পর তো পড়ালেখা”। বাবা সম্মতি সূচক ঘার নাড়ালেন। কাকু উঠে চলে যেতে যেতে বললো, “খবর তাহলে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে। তাড়াতাড়ি যাই, দেরি করা ঠিক হবে না, আর যদি জানাজানি হয়ে যায় যে আমি এখানে, তাহলে তো আপনারও বিপদ।” বাবা বললো, “আচ্ছা, রহমত সাবধানে থেকো, কাকু বললো এই মনে হয় শেষ দেখা। না হয়, এর পর যেন দেখা হয়ে নতুন দেশ, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।” বাবা কাকুকে জড়িয়ে ধরলো আর বললো আমি জানি আমরা পারবো। কাকু দরজার কাছে, যেতেই বাবা বললো, “রহমত ভালো ছুরি বানাতে লোহা ঠিকমত গরম করা দরকার তাইনা? লোহা গরম করার জন্য কিকি প্রয়োজনীয় জিনিস লাগবে জানিয়ে দিও ঠিক সময়ে, সব পাঠিয়ে দিবো, তাও দেশকে আমরা স্বাধীন করবো”। কাকু বাবার কথা শুনে বাবাকে জরিয়ে ধরলো আর বলতে লাগলো, স্বাধীন করবোই, করবো।
আজ সকাল থেকে বৃষ্টি নেই। চারিদিকটা কেমন যেন এক গম্ভীর রূপ ধারণ করেছে। বাবা যেতে চাচ্ছে মা বারণ করছে- “এই পরিস্থিতিতে যাওয়া ঠিক নয়, ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।” বাবা বললো, “মৃত্যু তো একদিন হবেই। তুমি চিন্তা করোনা। তুমি আর রুমা সাবধানে থেকো।” আমার বাবার নাম শফিক তিনি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আর আমি আমার বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে। আমার বয়স ১৭ ছুঁই ছুঁই। মানিকগঞ্জেই আমাদের বেড়ে ওঠা।
বাবা বের হতে লাগলো, মা বলল, খাবার নিয়ে যাও দুপুরে খেয়ে নিও। বাবা বলল, ও লাগবেনা। আমি বললাম, “বাবা তুমি যাও, আমি দুপুরে খাবার নিয়ে স্কুলে যাব। তোমাকে খাইয়ে আসবো”। বাবা হাসি দিয়ে চলে গেল। মা আপন মনে কি যেন বলতে বলতে রান্নাঘরে চলে গেল। আমি জানালার ধারে বসে ভাবছি নানা কথা, দেশের কেন এই অবস্থা? সবকিছু কবে ঠিক হবে। কবে ঘরথেকে নিভয়ে বাহিরে যেতে পারবো, আজ সব জিজ্ঞেস করবো তার কাছে। তার সাথে আজ নিয়ে একমাস হয়ে গেল কোনো দেখা হয়নি, কথা হয়নি।
বাবাকে খাবার দিয়ে ফেরার পথে তার সাথে দেখা।
রুমা, কেমন আছো তুমি?
আমি ভালো আছি, তুমি?
ভালো আছি, রুমা।
আমার পছন্দের কৃষ্ণচূড়া ফুল আনতে ভুলেনি পলাশ। কত দিন পর তোমার সাথে দেখা। আচ্ছা চলো বটতলায় গিয়ে বসি। এভাবে কথা চলতে থাকলো…
বটতলায় বসে আমি পলাশকে বললাম, আচ্ছা পলাশ দেশের এই অবস্থা কেন? করে সবকিছু ঠিক হবে? পলাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, এই পাকিস্তানি মিলিটারিদের দেশ থেকে বের করে দিতে হবে তাহলে সবকিছু ঠিক হবে বুজলে রুমা?
কিন্তু কিভাবে?
কিভাবে মানে, যুদ্ধ করে, সংগ্রাম করে। দেশে যুদ্ধ চলছে, দেখছো না। দেখিও রুপা একদিন আমরা জয়ই হবো, আর এই পাকিস্তানি মিলিটারিদের দেশ থেকে বিতারিত করবো, আমি বললাম স্বাধীন হবোই, জয়ই হবোই, পলাশ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, আমি বললাম, “তুমি হাসছো কেন?”
তোমার হাসি, তোমাকে দেখিনা কতদিন তোমার হাসি শুনিনা কত দিন। পলাশ হঠাৎ কিসের যেন শব্দ শুনতে পেল। বললো, “রূপা বাড়ি চলে যাও। পরিস্থিতি ভালো নয়।”আমি বললাম, “আচ্ছা তোমার বাবা-মার কি অবস্থা এখন?”
বাবা আগের চেয়ে একটু ভালো কিন্তু মা সারাদিন কাদেঁ আর বলে পাকিস্তানিরা আমার বড় ছেলেকে মেরে ফেলেছে।
মার দিকে খেয়াল রেখো। ভাইয়ার কথা আমারো মনে পরে। যাওয়ার সময় পলাশ বলে তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
সবধানে থেকো, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
ভালো থেকো।
এই বলে আমরা বটতল থেকে চলে আসলাম।
শফিক সাহেব রাতে পায়চারি করছে। তাকে কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে, শফিক সাহেব ভাবছে, তাহলে কি মিলিটারিরা সব জেনে গেল? আমি যে স্কুলে পড়ানোর নাম করে ছাত্রদের যুদ্ধের জন্য তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেই। আমার নিজের জন্য চিন্তা নেই চিন্তা হচ্ছে রুমা ও তার। তারা যদি আমার বাড়ি চিনে ফেলে। না না এ হতে দেয়া যাবে না। সময় থাকতে তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এর মধ্যে রেডিওতে খবর এলো একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় অনেকে মারা গেছে। পরে জানা গেল রহমত কাকুকে মিলিটারিরা ধরে ফেলেছিল। মিলিটারিরা কাকুকে মেরে ফেলেছে। এ শুনে বাবা সারারাত ঘুমাতে পারেনি। রাতে নাকি পূর্বপাড়ায় মিলিটারিরা হামলা করেছে। সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলেছে এ শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। পলাশ ভালো আছে তো? ওর পরিবার ঠিক আছে তো? মনে অনেক রকম ভয় নিয়ে রাতটা পার করলাম।
সকালে খবর আসলো পলাশের বাড়ির সবাই মিলিটারির গুলিতে মারা গেছে, আমি আর ঠিক থাকতে পারছিনা, তবে পলাশ বাড়ি ছিলো না, পলাশ জানে বেঁচে গেছে। দুপুরের পরে পলাশের সাথে দেখা করার জন্য বটতলার গেলাম পলাশের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ওর চোখে আগুন জ্বলছে, আমি কিছু বলার আগে পনাশ বললো, “ওই পাকিস্তানিরা আমার পরিবারকে মেরেছে, আমি যুদ্ধে যাবো, দেশ কে স্বাধীন করে ফিরে আসবো, তুমি আমার অপেক্ষায় থাকিও।”
এই বলে পলাশ চলে গেলো। আজ নিয়ে বাইশদিন হলো পলাশ যুদ্ধে গেছে। তার আর কোনো খোঁজ নেই। আর বাবা দুঃশ্চিয়তায় সময়পার করছে। কখন কি হয়। মা, বাবার এই অবস্থা দেখে বললো চলো তাহলে আমরা কিছুদিনের জন্য বরিশালে চলে যাই। বাবা কিছুক্ষন চিন্তাভাবনা করে বললো, “ হ্যাঁ তোমাকে আর রুমাকে আমি রেখে আসি।” কিন্তু আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভবনা। রেডিওতে শোনোনি, বঙ্গবন্ধু কি বলেছে? আমাদের যাকিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থেকো বাংলার মাটিকে শত্রু মুক্ত করতেই হবে।
রুমা আমরা পারবো বাংলার মাটি থেকে, এই পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করতে। বাবার কথায় সিদ্ধান্ত হলো আমি, মা বরিশালে চলে যাবো, কাল বাবা রেখে আসবে। রাতে আমরা সবকিছু গুছিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম, গভীর রাতে ‘হঠাৎ কিসের যেনো আওয়াজ মনেহয় গুলি চলছে। হঠাৎ আমাদের দরজায় কে যেন জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি। বাবা-মা ভয়ে লুকিয়ে আছি। দরজা ভেঙে মিলিটারিরা ঘরে ঢুকলো। সকালে ছাত্রদের মুখে শোনা গেল কাল রাতে মিলিটারিরা শফিক সাহেবের পরিবারকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। কেউ বেঁচে নেই।
এই দিক এ পলাশ ও বাহিনীরা আজ রাতে এক অপারেশন চালাবে। তারা ঠিক করেছে যাই হোকনা কেন মিলিটারিদের দেশ থেকে নিঃশেষ করতে হবে। তারা যুদ্ধ করে এবং সফল হয়। হাজারো নিরীহ প্রাণের বিনিময়ে -এই বাংলাদেশ। পলাশ জয়ী হয়ে যখন গ্রামে আসে তখন পলাশ শুনে রুমা আর নেই, মিলিটারির হাতে মারা পড়েছে রুমা। ১৯৭১ সালে রুমা-পলাশের মতো কত প্রেম অপূর্ণ রয়েছিল। এই ১৯৭১ সালে দেশকে, দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে গিয়ে কত শত মানুষ তার জীবন দিলো, কতমা তার ছেলেকে হারালো, ভাই হারালো ভাই কে, আর কত অপূর্ণ রইলো জানা, আজানা প্রেম কাহিনী।
মঙ্গল যাত্রা
খন্দকার তাযকিরাহ্
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ
কিছুতেই ঘুমাতে পারছেন না লিলিমা। বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ–ওপাশ ফিরছে সে। রাত এখন ২টা। নাসার একটা বড় মিশনের ক্যাপ্টেন করা হয়েছে তাকে। খুবই বিপজ্জনক মিশনটা। প্রাণের নিশ্চয়তা নেই। তবে ভাগ্য ভাল থাকলে তারাই মঙ্গল গ্রহে পা রাখা প্রথম মানুষ হবে। সেখানকার গ্রাভিটি পৃথিবীর ৩৮% মাত্র। সেই পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তাকে বেশ কঠিন একটা ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। সেই ট্রেনিং-এ যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের নিয়া একটা টিম গড়ে তুলেছে নাসা। মঙ্গল গ্রহের মাটি অনেক বিষাক্ত। যদি কোন প্রাণনাশি জীবাণুর কবলে পড়ে তার টিমটা, তাহলে? খুব জোর করে এসব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে ঘুমনোর চেষ্টা করল।
ভোররাতেই লিলিমা হেড অফিসে উপস্থিত হল তার বাকি টীম মেম্বারদের সাথে। ৮ জনের টিম তাদের। ধীরে ধীরে সব প্রস্তিতি নেওয়া শেষ করল তারা। পরিবারের কাছ থেকে বিদাই নিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সকাল ১০টার দিকে উৎক্ষেপণ করা হল তাদের মহাকাশযান। অনেক মানুষ দেখতে এসেছে তাদের মহাকাশযান উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান। চারদিক ধোঁয়া দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করল তাদের মহাকাশযানটা সেকেন্ডে ১২৮২৯ মিটার গতিবেগ নিয়ে। বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাকাশে প্রবেশ করল তাদের মহাকাশযান। স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে লিলিমার কাছে। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি আচ্ছন্ন করল তাকে। সে হাওয়ায় ভাসছে! আনন্দে ভরে গেল তার মন। দেখতে দেখতে চাঁদকে অতিক্রম করল তারা। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য!
৯ মাস পর। আজ তারা মঙ্গলে অবতরন করবে। উত্তেজনার সীমা নেই কারও। তাদের কমান্ডার অল্গ্রিন সবাইকে নিয়া তৈরি হলেন। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মঙ্গলের বুকে অবতরন করল। বেশ ভাল ভাবেই অবতরন করতে পারায় তাদের মাঝে আনন্দের সীমা নেই। এখন সামনে এরেকটা চ্যালেঞ্জ – মঙ্গল গ্রহে বেঁচে থাকা! পর্যাপ্ত অক্সিজেনের সিলিন্ডার ও পানি আছে তাদের সাথে। দীর্ঘ দিন ওজন শূন্য থাকাই তাদের শারীরিক কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই কিছু দিন বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
৪ দিন পর তারা মঙ্গলের মাটিতে তারা পা রাখল। সবাই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগে এই লাল গ্রহটা। তাদের প্রথম উদ্দেশ্য হল কোন প্রাণের অস্তিত্ত খুঁজে বের করা। তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করতে থাকে। তারা মঙ্গলের মাটি, পাথর – এমন বিভিন্ন জিনিস নিয়ে পরীক্ষা – নিরীক্ষা করতে থাকে। আর ফলাফল সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেই হেড অফিসে।
এই ক দিনে তাদের এক সহকর্মী বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। অবস্থা বেশি একটা ভাল না। মারিয়ানা তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠা। সে একদিন একটা পাথর পরীক্ষা করতে করতে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করে। মাইক্রোস্কোপ দিয়া দেখে – একটা ব্যাকটেরিয়া। বেশ উত্তেজিত হয়ে সবাইকে জানায় সে, ৪ মাসের এই মঙ্গল ভ্রমণের সফলতায় সবাই বেশ খুশি। পরদিন লিলিমা বসে সেই ব্যাকটেরিয়া পর্যবেক্ষণ করছে। ঠিক তখন পেটার নামে এক সহকর্মী এসে খবর দেয় তাদের সেই সহকর্মী মারা গেছে। একে একে সবাই অসুস্থ হতে থাকে। কেমন যেন পাগলের মত আচরন তাদের। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় ওই ব্যাকটেরিয়ায় তারা আক্রান্ত হয়েছে। এটা প্রথমে মস্তিষ্কে আক্রমন করে, তারপর ধীরে ধীরে সব জৈবিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেই আর ১ সপ্তাহের ভিতরে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। সবাই সংক্রমিত হয়ে গেছে, মারিয়ানা বাদে। সে যদি তার বাকি সহকর্মীদের ফেলে মহাকাশযানটা নিয়ে একা ফেরত যায়, তার বেঁচে যাওয়ার একটা সম্ভবনা আছে। তাই সে মঙ্গলেই তার অসুস্থ সহকর্মীদের ফেলে স্পেসশিপ নিয়া পৃথিবীর দিকে রওনা দেয়। কিন্তু ২ দিন বাদেই স্পেসশিপটাতে গণ্ডগোল দেখা দেই। সেটা তার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। তার আর কিছুই করার থাকেনা। সে তার ডাইরিতে তার মঙ্গল যাত্রার সব ঘটনা লিখতে থাকে। সেখানে মারিয়ানা লিখে এই পৃথিবীকে সে অনেক ভালবাসে। কিন্তু মানুষ যেভাবে পরিবেশকে দূষিত করতে শুরু করেছে যে আজ পৃথিবী ধ্বংসের মুখে। সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত এই সুন্দর পৃথিবীর কোন বিকল্প হতে পারে না। মঙ্গল গ্রহে মানুষ বসতি স্থাপনে সফল হলেও সেখানে জীবনের ছন্দ পৃথিবীর মত হবে না। এদিকে কিছু দিন পড়ে মারিয়ানা বুঝতে পারে সেও সেই প্রাণনাশি ব্যাকটেরিয়া দারা আক্রান্ত।
বিজয়ের সুখ
প্রিয়দর্শিনী পাঠান
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে যাচ্ছে ওভি। স্কুলে যেতে তার ভীষণ ভালো লাগে। পড়ে সে প্রথম শ্রেণিতে। স্কুল শেষ হয়েছে বেশ আগেই। তবে, বন্ধুদের সঙ্গে দাড়িয়াবান্ধা আর গোল্লাছুট খেলতে গিয়ে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। মা দুশ্চিন্তা করবেন না, মাঝেমধ্যেই তার দেরি হয়। বাড়িতে ফিরে দেখে বাবা পাড়ার কাকাদের সঙ্গে কি নিয়ে যেন কথা বলছে। সে তারাতারি জামা-কাপড় পালটিয়ে বসার ঘরে যায়। কাকারা নাকি এইমাত্র গেল। বাবা ওভিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে নিলেন।
- বাবা, কি হইসে? সবাই এত ব্যস্ত হয়ে আছে কেন?
- তুইও দেখি জানোস। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আজকে ভাষণ দিসে।
বঙ্গবন্ধু কে সেটা ওভি আগে থেকেই জানত। তিনি হলেন তাদের পূর্ব পাকিস্তানের একজন নেতা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের ওপর অত্যাচার করে, ওরা অনেক খারাপ।
- উনি কি বলসেন?
- তা তুই বুঝবি না।
- বলো না, বাবা।
- ঠিক আছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার কথা বলেছে। বলেছে, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আমাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার জন্য বলছে। কিছু বুঝলি?
- উম… যুদ্ধ!
দেশের এই পরিস্থিতিতে কিছু দিন হলো ওভির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে এখন নিজে নিজে পড়াশোনা করে। মা-বাবা মাঝে মাঝে তাকে সাহায্য করেন। আর বাকি সময় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলা করে, দাদির কাছে বিভিন্ন রকম গল্প করে আর মাকে পারলে সাহায্য করে। কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে ওভিদের গ্রামের সকলের এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। সুব্রত দাদা সহ ঢাকায় তাদের গ্রামের যারা থাকত, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই চলে এসেছে। ভয়ে ভয়ে কি চলছে তা সুব্রত দাদার কাছে জানতে চাইলো। জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল, “এইবার হয়তো আমরা সত্যিই জয়ী হব।” বিষয়টা ওভির কেমন জানি লাগলো।
২৭শে মার্চ ১৯৭১
ঘুম থেকে উঠেই ওভির কেন জানি মনে হতে লাগল বিরাট কিছু হয়ে গিয়েছে। বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখে গ্রামের সব মুরুব্বিরা মিলে আলোচনা করছেন। তাদের চেহারায় এক অন্যরকম ভাব ফুটে উঠেছে। একটু ঘুরাঘুরি করেই সুব্রত দাদাকে পেয়ে গেল সে।
- কী হইতেসে, দাদা?
- ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী হামলা চালাইছে। ঢাকা আমাদের করিমগাঞ্জ থেকে বেশ দূর। তাই খবর আসতে দেরি হইসে।
- সুব্রত দাদা?
- বল…..
- এখন কী হবে?
- মানে?
- আমরা কি যুদ্ধ করবো?
- অবশ্যই করতে হবে।
দিনের পর দিন যায়। এর মধ্যে কয়েকদিন তাদের বেশ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যায়। শহর থেকে অনেক মানুষ তাদের গ্রামে এসেছিল। বেশিরভাগই আরও দূরে যাবে। কেও কেও পাশের গ্রামের। একটি পরিবার তাদের বাসায় দুইদিনের জন্য ছিল; এক মা আর তার তিন ছেলে-মেয়ে। বাচ্চাগুলর জন্য ওভির অনেক কষ্ট লাগল, কেননা, তাদের বাবাকে নাকি পাক-বাহিনী মেরে ফেলেছে। তার খুব রাগ হলো, একজন ডাক্তারকে ওরা কেন মারবে! বুঝে উঠতে পারে না ওভি।
কিছুদিন পর…
অগ্রহায়ণ মাসের শুরুটা হলো বেশ বাজে ভাবে। ওভি যেটা ভয় পাচ্ছিল, সেটাই হলো। পাকবাহিনী তাদের গ্রামে দু’দিন হলো এসেছে। বাবা তার আগে থেকেই বাড়ি নেই। কোথায় গিয়েছেন সে জানেনা। এরই মধ্যে একদিন তাদের ক্লাসের গিতা ও তার পরিবারকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। এখন আর সে খেলতে যায় না। তবে, একদিন তাদের বাসায় মুক্তিযোদ্ধা কাকারা এসেছিল। বলল, তারা ওর বাবার কথায় এখানে এসেছে। মা খাবার বানাতে বানাতে সে মুক্তিযোদ্ধা কাকাদের সঙ্গে গল্প করে নিয়েছিল। তাদের রাইফেলটাও সে ধরেছিলো, নিজেকে মুক্তিবাহিনী মনে হচ্ছিল। একদিন তার প্রিয় বন্ধু সজিব তাদের বাসায় আসে।
- কেমন আছস, ওভি?
- ভালো। তুই?
- ভালা আছি। ফাকবাহিনী দেখত যাবি নি?
- ফাকবাহিনী না, পাকবাহিনী। আমাদের যদি ওরা ধইরা নিয়া যায়?
- আরেহ! হেরা আমাগো ধইরা নিবো না! আমরা মুসলমান আর বাচ্চা মানুষ, আমাগো ধরবো না।
- বললেই হলো নাকি? ওরা অনেক খারাপ।
- আচ্ছা, যদি আমরা ধরা পরি, ছাড়া পাওয়ার দিন তোরে আমি দুইডা বাতাসা খাওামু, এই দেখ আমার কাসে টেহা আসে।
- ……… আইচ্ছা, চল।
ওভিদের গ্রাম পাশের গ্রামগুলো থেকে বেশ উন্নত, কিছু পাকা রাস্তাও আছে ওদের গ্রামে। তবে ধান খেতের ধারে মেঠোপথটা দিইয়েই সে যাতায়েত করত। সেই পথটাই তার প্রিয়। আজও তারা সেই পথ দিয়ে যাচ্ছে। তবে, কারণটা হলো, ওভি বড় রাস্তা দিয়ে যেতে চাইছিল না। তার মনে ভয় হচ্ছিল, যদি তাদের মেরে ফেলে! সে তো এখনো অনেক ছোট!
অবশেষে তারা পৌছালো তাদের স্কুলে, সেখানেই পাকবাহিনীর ক্যাম্প।
- ভেতরে যাবি নি?
- না থাক।
- হাইরে ভিতুর ডিম, আমি এই পর্যন্ত দুইবার আইসি। আমারে কি ধইরা নিয়া গেসে? চল আমার লগে।
সজিব তাকে ভিতুর ডিম বলায় সে বেশ চটে যায়। মুখ গোমরা করে সে বলল, “আচ্ছা।” সজিব হেসে দিলো।
দারওয়ান এর মতো দেখতে একটা লোককে চেয়ারে বসে ঘুমাতে দেখে আস্তে আস্তে তারা ভেতরে গেল। কাছা-কাছি এসে ওভির কাছে স্কুলটা কেন জানি ভুতূরে মনে হলো। তারাতাড়ি আরেকটা ঝোপে ঢুকে পড়ল তারা। তাদের স্কুল বিল্ডিং-এর ডান দিকে এক জায়গায় রান্না হচ্ছে। একটা গরুও বাঁধা আছে। সেটাকে দেখিয়ে সজিব বলল, রহমত কাকার গরু, কাল রাতে চুরি করসে হেরা। তুই ক্যামনে জানলি? আরেহ! হে তো আমাগো দুই বাড়ি পরেই থাকে! খবরটা শুনা হয় নাই!
আরও কিছুক্ষণ থেকে তারা বের হলো। তবে, বাইরেই ওভিদের যেতে সমস্যা হলো। দারোয়ান উঠে গেছে। একটা লোক তাকে উর্দুতে বকাবকি করছিলো। হয়তো সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো বলে।
- এইরে! এখন কি হবে?
- সেটা তুই জানোস। তুই না আগে দু’বার আইসিলি?
- তহন তো হে ঘুমায়সিলো!
- আচ্ছা, তাহলে এখানেই একটু অপেক্ষা করি।
- তাসারা কিসুতো করার নাই ……
কিছুক্ষণ পর লোকটা চলে গেল। একটু অপেক্ষা করেই বের হয়ে এলো ওরা। তবে, তারা খেয়াল করেনি যে একটা লোক তাদের দিকে আসছিলো। হঠাৎ একটা ডাল ভাঙ্গার আওয়ায পেয়ে সজিব ফিশফিশ করে বলল, “প্রাণের ভয় থাকলে পালা।” আর সেই বলে দুজনে একসঙ্গে দিল দৌর।
কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিলো দুই বন্ধু। কোথায় গিয়েছিলো সেটা জিজ্ঞেস করতেই ওভি তার মাকে বলল, “এইতো কাছেই।” কাউকে কিছু বলবে না বলে ঠিক করেছে সে। সেদিন রাতেই দাদি তাকে ডাকল। দাদিমা বলেন, রাতে বাচ্চারা বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে কথা বললে তার আয়ু কমে যায়। তাই, তাকে রাতে ডেকেছেন বলে সে বেশ দিশাহারা বোধ করলো।
ওমা! বাবা বাসায়! কবে এলেন? ঘড়ে ঢুকেই সে ভয় পেয়ে গেল। দাদির মুখ ফ্যাকাসে, মা চোখের জল মুছছেন। সে বলে উঠলো, “বলবা তো কি হইসে! আমার কিন্তু ডর লাগতাসে!”
“তুই, তোর আম্মা আর তোর দাদি ভারতে চইলা যাবি”, বাবা আস্তে আস্তে বললেন।
মা বলে উঠলেন, “আমরা থাকি না! আফনি দ্যাশের লিগা যুদ্ধ করবেন, আমি পারলে আমার পোলারেও দিতাম, কিন্তু, হে তো ছুডু। আমি আর আম্মা না হয় মুক্তিযোদ্ধাগোর সেবা করলাম!”
দাদি বললেন,“আমি একমত। আর, আমাগো যদি মরণ হয়, সেইডা নাহয় মাতৃভূমিতেই হইলো! তাছাড়া, ভারতে তো মানুষ খুব আরামে নাই!”
দাদির কথা শুনে কিছুক্ষণ ভেবে বাবা রাজি হয়ে গেলেন। ওভিকে আদর করে চলে গেলেন।
নভেম্বর মাস শেষ। পাক-বাহিনীদেরকে বাবারা অনেক বার আক্রমণ করে। কিন্তু, বাবারা জিতে না। এর মধ্যে কয়েকবার কিছু খারাপ লোক এসেছিলো তাদের বাড়িতে। শেষবার মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। তবে, সুব্রত দাদার কারণেই বেঁচে গিয়েছিল। প্রতিদিন অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। ওভির মনে হলো, কখনই তাদের জয় হবে না।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সকালটা সেদিন ছিল বেশ শান্তিপূর্ণ। কারণ সেদিনই যে ওভির সবচেয়ে আনন্দের দিন! মুক্তিযোদ্ধা কাকারা অবশেষে পেরেছেন, পশুরা হেরেছে। তবে, বাবাকে ছাড়া যে তার একদমই ভালো লাগছে না। তবে দুপুরেই আসলেন বাবা। মা আর দাদি কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। ওভিও অবশেষে পেল বিজয়ের সুখ।
দরজাটা আজও খোলা
অনিক ভট্টাচার্য্য
প্রান্তিক
শহুরে ছেলে প্রভাস। সেরকম গ্রামীণ পরিবেশে থাকার সৌভাগ্য হয়নি, জন্ম শহরে, পড়াশুনো বিদেশে তাছাড়া জন্মের অনেক আগেই গ্রামের জায়গাজমি বিক্রি বাট্টা করে প্রভাসদের পরিবার আর দেশের বাড়ি যায়নি, তাই প্রভাসেরও গ্রামের বাড়ির স্বাদ গ্রহন করা হয়নি, স্কুল-কলেজে বাবার বন্ধু বান্ধব বা স্বজনদের কাছে গ্রামের বাড়ির গল্প শুনে স্বপ্নে হারিয়ে যেতো, সেই দুপুরে চুপচাপ হয়ে যাওয়া গ্রামের বাড়ি লাগোয়া নির্জন পুকুরের ধারে চুপচাপ বসে থাকা, থেকে বর্ষায় মাটির ঘরে টিনের চালায় বৃষ্টির আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গা থেকে কত কি? এসব শুনতো আর স্বপ্ন দেখতো, যদিও এক্কেবারে যে কোন গ্রামের বাড়ি যায়নি তা কিন্তু না, ছোটবেলায় মায়ের কোন এক পরিচিতের বাড়িতে বিয়ের নেমন্তন্ন যাওয়া, এরপরও ছুটো ছাটা বার দু চারেক এর ওর গ্রামের বাড়িতে যওয়ার সুযোগ হয়ে ছিল। কিন্তু সকল যাওয়াই অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক, তাই তেমন গ্রামিন অনুভুতি সে পেলোও, তা মন মতো ছিল না।
এরই মধ্যে বিদেশ থেকে পড়াশুনোর পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে আসে। এরপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চাকরি, বড়ো কোম্পানী বেশ নামডাক, বেতনও মানসম্মত পছন্দসই। অফিসে যোগ দিতেই সকলের সাথে পরিচয় হয় রাহুলের। কাজ করতে করতে অন্যদের থেকে রাহুলের সাথে সখ্যতা বেশি গড় ওঠে, একদিন কথার কথায় প্রভাস গ্রামের প্রতি তার দুর্বলতা আর দুর্ভাগ্যতার কথা বলে। রাহুল শুনে রাহুল তার সাথে একদিনের জন্য গ্রামে থাকার কথা বলতেই রাজি হয়ে যায়, পরের সপ্তাহে ছুটির দিন দুই বন্ধু মিলে রাহুলদের দেশের বাড়ি মানে গ্রামের বাড়িতে যায়, যেতে কমপক্ষে দুটো বাস, একটি নৌকো আর বেশ কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হলো, কাঁচা রাস্তা এবড়োথেবড়ো, চারপাশ সবুজময় ধান ক্ষেত, দিকে দিকে সব কাঁচা বাড়ি, ঠিক যেমনটা প্রভাস চেয়েছে। চারপাশ মুগ্ধের মতো দেখত দেখতে উপভোগ করতে থাকে। এরপর অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে পৌঁছালো রাহুলদের বাড়ি। বেশ সুন্দর মাটির দোচালা বাড়ি। উঠোনে ডালের বড়ি শুকোতে দিয়েছে, সামনে একজন বৃদ্ধ লোক গায়ে তেল মেখে রোদ পোহাচ্ছেন। রাহুলকে প্রনাম করতে দেখে প্রভাসও প্রনাম করলো, এরপর রাহুল পরিচয় করিয়ে দেন উনি রাহুলের দাদু।
রাহুলের গলা শুনে রাহুলের মা বের হয়ে এলো বাড়ির ভেতর থেকে, রাহুলের মা শহরেই থাকে। আজকে প্রভাসের সুবাদে অনেক দিন পর গ্রামে আসলেন। বাড়ির পাশেই রাহুলদের নিজস্ব পুকুরের টলটল করা পরিষ্কার জল। কারন পুকুর টা যেহেতু ব্যক্তিগত, তাই চারপাশ ঘেরা দেওয়া প্রাচীর। শান্ত জল, দু’পাড় জুড়ে অনেক রকমের গাছ লাগানো, তার মধ্যে আমগাছ মনে হলো সবচেয়ে বেশী। গাছের ডাল ফলের ভারে পুকুরের জল ছুঁই ছুঁই করছে। রাহুল আর প্রভাস দুই বন্ধু পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে অনেক্ষন বসে গ্রীষ্মের শান্ত দুপুর উপভোগ করলো কিছুক্ষন। চারপাশে ঘন গাছপালা ঘিরে থাকার কারনে তেমনটা কড়া রোদ গা জ্বালাতে পারছেনা। চারপাশ নিঃস্তব্দ, নেই কোন লোকের সারাশব্দ, শহুরে মানুষের মতো ব্যস্ততা, নানা ফেরিওয়ালা, বা মোটরজান। অজাচিত কোন শব্দই শোনা যাচ্ছে না। শুধু থেকে থেকে পাখির কিচির মিচির ডাক আর মাঝেমধ্যে নাম না জানা পাখির গান ছাড়া কিচ্ছুটি শোনা যাচ্ছেনা। হটাৎ মৌনতা ভেঙ্গে রাহুল প্রভাসকে বললো, “চল তোক আজ ফোকলা বুড়ির বাড়ি নিয়ে যাই।” অদ্ভুত নাম শুনে প্রভাস হা করে রাহুলর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই রাহুল বললো, “আরে জানি তুই চিনিস না। আর উনার আসল নাম কেউ জানেনা, সামনের কয়েকটা দাঁত ছাড়া কথা বলেন বলে এই নাম। আমাদের খুব ভালোবাসেন, উনার বাড়িতে নেওয়ার উদ্যেশ্য হলো দুনিয়ার এমন এক ঘর যা গত ৫০ বছরেও এক মুহুর্তের জন্য বন্ধ হয়নি, ঝর, বৃষ্টি, রাত দিন, বুড়ি ওখানেই দরজার সামনে বসে ভাত, ঘুম, সব ওখানেই। টানা ৫০ বছরে এর ব্যতিক্রম হয়নি, এর পিছে এক দেশের গর্বিত দেশপ্রেম, দেশের জন্য আত্মত্যাগের ঘটনা আছে।” এরপর দুই বন্ধু মিলে ফোঁকলা বুড়ির বাড়ি গেলো, প্রভাস গিয়ে দেখেন সত্যি সত্যি এক বুড়ি দরজার ভেতরে বসে পান খাচ্ছে, আর দূরের রাস্তার দিকে এক মনে তাকিয়ে আছেন। চোখগুলো কুচঁকে আছে, হয়তো বয়েসের জন্য দৃষ্টি শক্তিও ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হলো, দরজার সামনে প্রভাস আর রাহুল যেতেই বুড়ি চোখ কুঁচকে কে এসছে ঠাওর করার চেষ্টা করে, হটাৎ চোখে-মুখে খুশির ঝলক ছড়িয়ে পড়লো, অসমর্থ দুর্বল গলায় বললো, “কিরে খোকা তুই এলি? এদ্দিন লাগলো তোর আসতে?” রাহুল বললো না গো আমি খোকা নই, তোমাদের রাহুল গো। বুড়ির আবার হাসি মাখা মুখটার হাসি মিলিয়ে গেলো, বুড়ি বললো “আমি ভাবলুম আমার বেটা এলো, আজও আসেনি।”
বুড়ি বলতে লাগলো, “আমার ছেলে অজয় সে ছোট্টবেলা থেকে চঞ্চল প্রকৃতির ছিলো, একফোঁটাও ঘরে মন টিকত না। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুড়ে বেড়াতো, কিন্তু যা কিছু হোক না কেন দিন শেষে ঘরে তার ফিরতেই হবে। মায়ের হাতে ভাত না খেলে আর মায়ের কোলে মাথা না রাখলে ওর শান্তি হতো না। ছোট্ট বেলা থেকেই আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। এরপর ধীরেধীরে বড়ো হলো, পাড়ার ক্লাবে, আড্ডা, শহরে সপ্তাহে যেতো মাঠের ধান মাড়াই করার পর চাল বেচঁতো। ছেলে তার মা কে যতটা ভালোবাসতো দেশকেও ততোটাই ভালোবাসতো।”
তখন দেশে আগুন জ্বলছে, শহর বন্দর দেশ দ্রোহীরা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, মানুষ মারছে, আমাদের নিজের দেশে নিজেরা পরাধীন। দেশ প্রেমিক দামাল ছেলেরা তখন সবাই যুদ্ধে নেমেছে। আমার খোকা শহরে গিয়ে দুবার মরার পথ থেকে ফিরে এলো, একদিন সকালে আমাদের ঘুম ভাঙ্গলো পাশের বাড়ির মাখনের মায়ের কান্না, বেশ ক’দিন হলো মাখন যুদ্ধে গেছে, কতো বারন করলো! শোনেনি, চলে গেলো, খোকা যতই চঞ্চল হোক, ছিল ভীতু প্রকৃতির, খোকাকেও মাখন বলেছিলো কিরে দেশ প্রেম দেখাস এতো, এখন ঘরে কেন, যুদ্ধে যাবিনা? খোকা কোন উত্তর দিতে পারেনা, সারাদিন চুপচাপ থাকে, কোথাও যায়না, প্রায়ই আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোয়, মাঝে মাঝে লুকিয়ে চুরিয়ে মাখন বাড়িতে আসে তখন দুই বন্ধু আড্ডা দেয়, কারন দেশে যুদ্ধ চলছে, আর শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়েছে, দেশেরই কিছু লোক, সে সকল দেশদ্রোহীরা কোথায় কোথায় যোদ্ধারা আছে সব শত্রুদের জানিয়ে দেয়। তাই সবসময় লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে আসতো মাখন, আর ছোট্ট বেলার বন্ধু আমার খোকার সঙ্গে আলাপ করতো প্রান খুলে, দেশের লড়াইয়ের গল্প, শত্রুদের এক এক মারতো। দেশদ্রোহীরা পাক বাহিনীর কাছে দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের অবস্থান পাচার করতো। আশঙ্কা একদিন সত্যি হলো, এই গ্রামেরই পোস্ট মাস্টার লুকিয়ে আসতে দেখে মাখনকে। পোস্টমাস্টার ছিলো সেসব দালাল দেশদ্রোহীদের একজন, যারা দেশের যোদ্ধাদের অবস্থান ও পরিচয় শত্রুদের দিয়ে দিতো। মাখন রাতের আধাঁরে লুকিয়ে এসছিলো মায়ের কাছে। মা ও আদর করে পছন্দের পাঁঠার মাংস রান্না করে, খেতেখেতে তৃপ্তিতে খুশি হচ্ছিলো মাখন। হটাৎ দরজায় করাঘাত। মাখনের মা দরজা খুলতেই, ধাক্কা দিয়ে, আর্মি ঘরে ঢুকলো। তখন মাখন খাচ্ছিলো, ঐ অবস্থায় তুলে নিয়ে যায় আর্মি। বেশ কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর একদিন সকাল বেলায় পুকুরে মাখনের দেহ ভেসে উঠেছে। সারা দেহ অত্যাচারে নির্মম ছবি ফুটে উঠেছে। সেই দিন থেকে আমার খোকা কেমন একটা বদলে যায়, যে ছেলে যুদ্ধের ভয়ে বের হতোনা ঘর থেকে, মাখনের মৃত্যু আমার খোকাকে নাড়িয়ে গেলো, জেদ ধরলো যুদ্ধে যাবে, সেদিন খুব কেঁদেছি আমি, বাপ আমার আমি একা তোর বাবাও নেই, কাকে নিয়ে বাঁচবো? অনেক কষ্টে দিব্বি দিয়ে আটকে রাখলাম, ছেলে আমার মন মরা হয়ে পরে রইলো দিনরাত ভালোমতো খেতে চাইনা। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরের দরজা হাট করে খোলা। দরজার পাশের খোকার খাট এক্কেবারে ফাকাঁ, ভোর হতে হতে কোথায় চলে গেলো, আর এলোনা। এরপর মাস ছয়েক পর বাইরে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি, হটাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ, চিৎকার করলাম কে? প্রথমে কোন সাড়া নেই, আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, এবার সাড়া এলো, “মা আমি খোকা, খোলো তাড়াতাড়ি”। খুলে দেখি কালো জামা, লম্বা লম্বা চুল, ঘন দাড়ি, কাঁধে ঝোলানো অস্ত্র। ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে খোকা। খোকা আমার হাজার বারন সত্বেও, দিব্বির পরও যুদ্ধে গেলি? “মা, এসব বাদ দাও, এদ্দিন পর বাড়ির কাছে এসে মান অভিমানটা আর ধরে রাখতে পারলাম না”, বলল খোকা। যুদ্ধে গেছে তাই সব সময় আসতে পারে না, গ্রামের চারপাশে দেশদ্রোহী গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, খবর পেলেই শত্রুদের দেবে। খুব ক্ষুদার্ত ছিলো, তাই চটজলদি হাড়িতে ভাত চাপালাম, ডিমভাজি আর ডাল করলাম; খোকা খুব ভালোবাসে। খাবার বেড়ে খেতে দিলাম এমন সময়, ঘরে একটা লোক ঢুকলো খোকার সহযোদ্ধা, কি যেন নাম, এখন আর মনে নেই। সেও ভেজা, কাঁধে অস্ত্র; এসে খোকাকে বললো, এক্ষুনি বের হতে হবে, শত্রুরা টের পেয়েছে। খোকা ওমনি ভাত মুখে না দিয়েই ছুটতে লাগলো। যেতে যেতে বললো, “মা, খুব ক্ষিদে পেয়েছে, আমি আসছি দরজা খোলা রেখো।” এই বলে সে ঘুটঘুটে ঝড়ের আধাঁরে মিলিয়ে গেলো, সেই থেকে খোকার অপেক্ষায় আছি।
যুদ্ধ শেষ হলো, সব মায়ের ছেলেরা ঘরে ফিরে এসছে, শুধু আমার খোকা এখনো এলো না। তবে আসবে দেখে নিস ঠিক আসবে, বলে হটাৎ হতাশার মাঝেও এক তীব্র অভঙ্গুর আত্মবিশ্বাস দেখা গেলো। গল্প শুনতে শুনতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো প্রভাসরা টেরই পেলোনা, এরপর ফোকলা বুড়িকে আসি বলে বেড়িয়ে এলো। দূর আকাশে সূর্য লাল রং ছড়িয়ে, দূর মাঠের শেষ প্রান্তে অস্ত যাচ্ছে, আর তখনো সে দিকে কুচকানো চোখে হতাশা মাখা মুখ নিয়ে ফোকলা বুড়ি তাকিয়ে আছে। যতো রাত হয় তত অপেক্ষাও বাড়ে; এই হতাশায় যে এখনো কোন দেশদ্রোহীদের নজর এড়িয়ে আসতে পারছেনা খোকা, কিন্তু খোকা এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছে দেশকে শত্রুদের হাত থেকে বাচাঁতে।
প্রিয় প্রতারণা
মোঃ রায়হান পারভেজ
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর
এই রিশান, ঘুড়ির সুতোটি ঠিকভাবে ধরো, উড়ে যাবে তো! নাদিয়ার কথায় যেনো হুঁশ ফিরে পায় রিশান। সুতোর প্রান্তটি শক্ত করে হাতে নেয়, যেনো সুতোটি ছুটে গেলে হারিয়ে যাবে তাদের স্বপ্নটিও।
সময়টি অগ্নিঝরা একাত্তর সালের শুরুর দিকের কথা। স্নাতকোত্তর পড়ুয়া রিশান ও স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ুয়া নাদিয়া। তারা আকাশে ঐ ঘুড়িটি ওড়ানোর মতই স্বপ্ন ওড়ায়- সে স্বপ্ন সারাজীবন ধরে একে অপরের পাশে চলার স্বপ্ন, বিশ্বস্ততার সারথী হিসেবে একে অপরের হাতটি ধরে রাখার স্বপ্ন। সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া, সীমাবদ্ধতার গন্ডি, অনিশ্চয়তার দোলাচলে থাকা আগামী এবং দেশের বিরাজমান সংকটময় পরিস্থিতি কোনো কিছুই তাদের অনিন্দ্যসুন্দর স্বপ্ন দেখায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না।
একাত্তরের মার্চের শেষ সপ্তাহ- বাংলার মাটিতে প্রবেশ করলো পাকিস্তানি সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত দখলদার বাহিনী। শুরু হলো তাদের অত্যাচারের আগুনে তৈরি হওয়া লেলিহান শিখার দাবদাহ। রাজধানী ঢাকার অন্যান্য এলাকার মত রিশান ও নাদিয়ার এলাকাতেও বিরাজ করছিলো চাপা উৎকন্ঠা ও উত্তেজনা। রিশানের বাবা স্থানীয় কলেজের দর্শন বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক ড. আজগর আলী। তিনি নিজে যেমন দেশপ্রেমে বলীয়ান তেমনি তার নিজ পুত্র রিশানকেও মানুষ করেছেন দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণটি তিনি তার বাবার থেকে উপহার পাওয়া টেপরেকর্ডারে বারবার নিজে শুনেন এবং তার পুত্র রিশানকে শোনান। তার মনে হয় স্বাধীনতা নামক সোনালী স্বপ্নটির যে বীজ বাঙালি বপন করে চলছিলো, বঙ্গবন্ধুর মোহনীয় কন্ঠে যেনো সেই বীজ পরিণত বৃক্ষের দিকেই ধাবিত হচ্ছে।
মুদ্রার ঠিক বিপরীত চিত্রটিই যেনো নাদিয়াদের বাড়িতে। নাদিয়ার বাবা জনাব করীম খান পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি যেনো তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তার আস্থা ও বিশ্বাসের একজন প্রতিমূর্তি স্বরূপ। তার কাছে বাঙালির মুক্তির স্বপ্নপূরণের মুক্তিসংগ্রাম এক নিতান্ত অভ্যন্তরীন কলহ বা গন্ডগোল হিসেবেই প্রতীয়মান হয় এবং তার বিশ্বাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তৎকালীন সরকার দ্রুতই এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে জনজীবন স্বাভাবিক করবে। কিছুদিন এভাবেই গড়িয়ে যায়….
হঠাৎ এক সন্ধ্যায় নাদিয়াকে রিশানের জরুরি তলব। রিশান নাদিয়ার হাত দুটি ধরে বললো, ‘ধরো আমি যদি চলে যাই দূরে তোমার দৃষ্টির অন্তরালে, তবে তুমি কি আমায় রাখবে মনে?’ নাদিয়া বিস্ময় চোখে ধারণ করে বলে, ‘এই মুখ, এই চোখ জম্ম-জম্মান্তরে শুধুই আমার, আমি তোমাকে আমার করে পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করতে পারবো। কিন্তু আজ হঠাৎ করে তুমি এ কথা কেনো বলছো?’ রিশান একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ’তুমি তো জানো দেশের এখন কি অবস্থা! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর তাদের অত্যাচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশমাতৃকার মুক্তির পানে গঠিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। আচ্ছা নাদিয়া, তুমি কি আমাদের পাশের বাসার শিপন ভাইকে চিনতে?’ নাদিয়া উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, চিনতাম তো, শুনেছি সে নাকি ভারতে অনেকদিন ছিলো।”
হ্যাঁ, সে ভারতে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষে গতকাল রাতেই ফিরেছে। সে এখন আমাদের সবাইকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করতে চায়। আমার বাবার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সম্মতি আছে। কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো না।
কেনো আমাকে হারানোর তোমার এত ভয়! তুমি অবশ্যই যাবে এই মা, মাটি ও মানুষকে রক্ষার জন্য। আমি চাই আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী আমরা গড়ে তুলবো স্বাধীন বাংলার মাটিতে।
অশ্রুসজল দৃষ্টিতে রিশান বিদায় নিলো নাদিয়ার নিকট থেকে। রিশান ছুটে চললো এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উম্মোচন করতে।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বহর ঐ দিকে অবস্থান নিয়েছে নাদিয়াদের বাড়ির পাশে। একদিন ঐ বহরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জামশেদ এলো নাদিয়াদের বাড়িতে, তার বাবা করীম খানের সাথে দেখা করতে। হঠাৎ নাদিয়া ক্যাপ্টেনের সামনে পড়ে যায় এবং নাদিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়ে ইতোমধ্যেই একবার বিয়ে করা ক্যাপ্টেন জামশেদ নাদিয়ার বাবার কাছে পেড়ে বসে নাদিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব। বাবা যখন নাদিয়াকে প্রস্তাবের কথা বলে তখন নাদিয়া ঘৃণাভরে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। নাদিয়ার বাবা তখন ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলেন, “আমি তোমার ও রিশানের কথা জানি। কিন্তু আমি তা কখনোই মেনে নেবো না। রিশান একজন বিদ্রোহী। তুমি যদি এ বিয়ের প্রস্তাব মেনে না নাও তবে আমি রিশানের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংবাদ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিবো এবং বুঝতেই পারছো তারা রিশানকে খুঁজে বের করে সপরিবারে হত্যা করবে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার-তুমি কী চাও? রিশানের জীবন নাকি তোমার গোয়ার্তুমি?” নাদিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।
সে জানে যদি এখন বাবাকে না বলে দেয় তবে রিশানের জীবনই শুধু বিপন্ন হবে না, তার সাথে পুরো মুক্তিবাহিনীর বৃত্তান্ত চলে যাবে পাকিস্তানি বাহিনীর করায়ত্তে, যার ফলে স্বাধীনতার দুর্বার স্বপ্নটি হয়তো থমকেই যাবে। মনের সাথে সকল যুদ্ধ সম্পন্ন করে এক আকাশ আবেগকে পাশে ঠেলে নাদিয়া বাবার প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। ক্যাপ্টেন জামশেদ নাদিয়াকে বিয়ে করে সেদিনই তাকে নিয়ে পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে চলে আসে।
গভীর রাত, সুনসান নীরবতা, সেই নীরবতাকে ভেঙ্গে ক্যাপ্টেন জামশেদ অট্টহাসি নিয়ে এগিয়ে আসে নাদিয়ার দিকে। কিন্তু তার সেই অট্টহাসি মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। নাদিয়া তার পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলো ধারালো এক ছুরি। ক্যাপ্টেন জামশেদ তার সামনে এলে নিজের দেহের সমস্তশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাপ্টেনের উপর, তার বুকে বিঁধে দেয় ধারালো ছুরি। মুহুর্তেই ক্যাপ্টেনের দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ক্যাপ্টেনের আর্তচিৎকারে পাশের কক্ষ থেকে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে অস্ত্রধারী দুই জন সেনা। তারা চোখের নিমিষেই গুলি বর্ষণ করে নাদিয়ার দিকে। চোখের পলকেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা ও রিশানের মায়াময় মুখটি কল্পনা করে নাদিয়ার অসাড় দেহটি মাটি স্পর্শ করে।
রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষ হয়, জয় বাংলার মুহুর্মুহু ধ্বনিতে মেতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশের পতাকা মাথায় তুলে ফিরে আসে নিজ ভূমে। সবার সাথেই বীরবেশে ফিরে আসে রিশান এবং সাথে ফিরে স্বাধীন দেশের মাটিতে নাদিয়াকে নিয়ে ঘর বাঁধার সেই স্বপ্ন। কিন্তু রিশানের মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগে না, নাদিয়াদের বাড়ি থেকে রিশানকে জানানো হয় যুদ্ধকালীন নাদিয়ার নিজ ইচ্ছাতেই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন জামশেদের বিয়ে হয় এবং তারা এখান থেকে চলে যায়।
রিশানের পুরো পৃথিবীটি থমকে যায় স্বপনভঙ্গের বেদনায়। বাকি জীবনটি রিশানের চিন্তা ও মননে নাদিয়ার রুপটি আঁকা হয়ে থাকে এক ছলনাময়ী, প্রতারক ও স্বার্থপরতার এক নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত হিসেবে।
আর নাদিয়ার কথা ভাবছেন- সে তো হেরে গিয়েও জিতে যায়। তার কালজয়ী আত্মত্যাগ রিশান হয়তো জানে না বা জানবেও না কোন দিন, কিন্তু নিজ ভালোবাসার মানুষ ও দেশমাতৃকাকে বাঁচানোর জন্য তার আত্মবিসর্জন পাঠক মনে সব সময়ের জন্যই দোলা দিবে।
স্বপ্ন
সামিন ইয়াসার
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
“আমার নাম নীলা কবীর। আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমার বাবা একজন ডাক্তার। আমার মা একজন নার্স। আমার শখ হচ্ছে বাগান করা। আমি বড় হয়ে ক্রিকেটার হতে চাই।” ক্রিকেটার হতে চাওয়ার কথা শুনে ক্লাসের সবাই হেসে দিল। বেশিরভাগ মেয়েরা হতে চায় ডাক্তার, পুলিশ অফিসার, গৃহিণী। কেউ ক্রিকেটার হতে চায় না। রুমানা ম্যাডাম ধমক দিয়ে সবাইকে থামালেন। তিনি আমাদের শারীরিক শিক্ষার ম্যাডাম। তিনি আমাকে কিঞ্চিত ভরসা দিয়ে বললেন, “বাহ, চমৎকার! তোমার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন আসলেই প্রশংসনীয়।” সবাইকে হাসতে দেখে আমি বেশ অস্বস্থিতে পড়লাম। আমাকে ছুটির পর ম্যাডাম নিজের লাউঞ্জে ডেকে পাঠালেন। আমাকে বললেন, “দেখো, তুমি জীবনে যাই করতে যাও না কেন, তোমাকে দেখে মানুষ ঠিকই হাসবে, সমালোচনা করবে। কিন্তু সেসব মানুষের ভয়ে নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না। আজকে হয়তো সবাই তোমাকে নিয়ে হেসেছে। তবে এ নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হলে চলবে না। তোমাকে তোমার অনুশীলনের দিকে নজর দিতে হবে। ক্রিকেটার হয়ে সবাইকে তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে হবে, একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। পারবে না? তোমাকে পারতে হবে!” আমি ম্যাডামের কথা শুনে অভিভূত। আমি ম্যাডামকে কথা দিলাম, যাই হোক না কেন আমি কখনোই আমার লক্ষ্য থেকে পিছপা হবো না।
আজ আবু ধাবিতে আইসিসি নারী বিশ্বকাপ ফাইনালে বাংলাদেশ বনাম ভারতের খেলা। আমাদের পরিবারের কারোর তেমন আগ্রহ না থাকলেও আমার আগ্রহ ছিলো তুঙ্গে। আমি সবসময়ই চেয়েছিলাম বাংলাদেশ মহিলা একাদশ বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে সবার চোখ রাঙিয়ে দিক। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, হায়! শেষ মেশ মাত্র ৩ রানে আমাদের পরাজয় বরণ করতে হলো। তবে এ পরাজয় খুব বেশি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় এমনটিও নয়। কারণ বাংলাদেশের মেয়েরা পায় না তেমন সুযোগ, দেয়া হয়না তাদের আশানুরূপ সমর্থন। তাদেরকে সমাজের মানুষ কী ভাববে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। এছাড়াও পরিবার-পরিজনদের ইচ্ছের নিচে চাপা পড়ে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে যুক্ত হতে হয় অন্য পেশায়।
আজ অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখ। ৩য় পিরিয়ডে শীলা ম্যাডাম ইংরেজি ১ম পত্র পড়াচ্ছিলেন। ম্যাডামের ক্লাসে হঠাৎ করে মাহি খালা এসে আমাকে ব্যাগ নিয়ে হেডমাস্টারের রুমে যেতে বলল। আমরা সবাই অনেক অবাক। আমি তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে গেলাম হেডমাস্টার স্যারের রুমে। স্যার আমার হাতে স্কুল লিভের পেপার দিয়ে চলে যেতে বললেন। আমি তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মা রোড এক্সিডেন্টে মামারাত্মক ভাবে আহত হয়েছে। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। বড় মামার গাড়ি বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বড় মামার গাড়িতে করে হাসপাতালে গেলাম। আমি হাসপাতালে গিয়ে একদম হতাশ হয়ে গেলাম। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁকে আইসিইউ (ICU) ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। আমি মার কেবিনের দরজার পাশেই বাবাকে দেখতে পেলাম। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেদিলাম। বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, “এভাবে ভেঙ্গে পড়লে কি হয়, মা? তোর মা দেখবি ঠিকই সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। পরে যখন বকুনি দিবে তখন আমাকে এসে কিন্তু আর বলতে পারবি না।” বাবার কথা শুনে আমার কান্না কিছুটা থামলো কিন্তু আমার মানসিক অবস্থার কোনো রূপ পরিবর্তন হলো না। আমি এক কোণায় একা বসে বসে মায়ের কথা চিন্তা করছিলাম। মায়ের শূন্যতা যে অপূরণীয় এটা ভাবামাত্র আমি নিঃশব্দে অশ্রু ফেলতে লাগলাম। হঠাৎ করে এ দুনিয়ায় নিজেকে বড়ই অসহায় অনুভব হলো। মামা এসে অনেকবার বললো তাদের বাসায় আজকের রাতটা কাটাতে। কিন্তু আমি মার জ্ঞান না আসা পর্যন্ত যাবো না বলে জেদ ধরলাম। মামা আর বেশি কথা বাড়ালেন না। তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন আমাকে এই মূহূর্তে জোর করা অযৌক্তিক।
রাতে না ঘুমানোর কারণে মাথা হালকা হালকা ব্যথা করছে। কিন্তু মাকে স্বীয় চোখে সুস্থ-সবল দেখার সেই আকাঙ্ক্ষার সামনে এ ব্যথা যেন হাতির সামনে এক ছোট্ট পিঁপড়া। একজন ডাক্তার মাকে ভিজিট করতে এলেন। তিনি রুম হতে বের হওয়া মাত্র আমরা ডাক্তারের কাছ থেকে সুসংবাদ শোনার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। ডাক্তার বলল, তিনি সুস্থ আছেন। আমার বাবা নিজেও একজন ডাক্তার, তবে ডেন্টিস্ট। আমি ডাক্তারের কথা শুনে কিছুটা আশাবাদী হলাম, আশাবাদী হতে চেষ্টা করলাম। সেই আশা পরিপূর্ণতা পেলো যখন শুনতে পেলাম মার জ্ঞান ফিরেছে। আমি প্রায় দৌড়ে মায়ের রুমে গেলাম। রুমের ভিতরে প্রবেশ করার পর মায়ের অবস্থা দেখে খারাপ লাগলো। সারা গায়ে অসংখ্য নল। মনিটরে কিছুক্ষণ পর পর বিপ বিপ শব্দ করছে। মার পাশে একটি চেয়ারে বাবা বসে আছেন। আমাকে দেখে মা একটু হাসার চেষ্টা করলেন। আমাকে ভালো বোধ করানোর জন্য তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা যেন আমার ব্যথাকে আরো ত্বরান্বিত করলো।
“আমার সামনে ঐ হাসি দিয়ে নিজেকে সুস্থ দাবি করার মিথ্যে অভিনয়টা আর করবে না। আমার এসব ভালো লাগে না।”
“ভালো থাকলে কি হাসবো না? তোর মতো সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকবো? আর স্কুলে যাসনি কেন? পড়াশোনাও কি আমার সাথে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।”
“তুমি সুস্থ হওয়া না পর্যন্ত স্কুলে যাবো না আমি।”
“তুই কি চাস আমি এখন এই অবস্থা থেকে উঠে এসে তোর গালে দু-চার ঘা লাগাই?”
এবার আমি সত্যি সত্যি হেসে দিলাম। মা তাহলে আসলেই পরিবর্তিত হয়নি। যদিও মা আমাকে স্কুলে না যাওয়ার জন্য বকা দিলেন, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হলো তিনিই চান তাঁর এই সময়ে তাঁর একমাত্র মেয়ে তাঁর সাথেই থাকুক। আমিও তো তাই চাই।
মা আমার সাথে একান্তভাবে কিছু কথা বলতে চাইল। সবাই যাওয়ার পর আমাকে তাঁর পাশে বসতে বললো। আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল কিন্তু আমি বাধা দিয়ে বললাম, “এসব নলের মাঝে কিভাবে জড়িয়ে ধরবে? তুমি সুস্থ হলেও তো আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে। এখন যদি এসব খুলে ফেলো তাহলে তো তুমি আর সুস্থই হবে না।”
“হ্যাঁ, মা। আল্লাহ্ যদি চায় তাহলে তো সুস্থ হবোই। কিন্তু তুই তো আমাকে দেখছিস ই। যদি আমি চলে…”
আমি মায়ের মুখে হাত দিয়ে বললাম, “এসব কি বলো তুমি, তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে, আসতেই হবে।”
“কিন্তু তাও যদি আমি না থাকি, তাহলে তোদের চলতে হবে। জীবন তো আর কারো জন্য থেমে থাকবে না।”
“তুমি কি সব আজেবাজে কথা বকছো?”
“আজেবাজে কই? আচ্ছা শোন, আমি না থাকলে সংসারের দায়িত্ব কিন্তু তোকেই নিতে হবে। তোর নিজের আর তোর বাবার দায়িত্ব তোকেই নিতে হবে। দায়িত্ব কাঁধে পড়লে ভয় পেলে চলবে না। শুধু যে তোকে পরিবারের দায়িত্ব নিলেই চলবে, তাও কিন্তু না। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিও তোর দায়িত্বগুলো ঠিকভাবে পালন করতে হবে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে।”
“ঠিক আছে। এবার ঘুমাও, মা।”
আমি রুম থেকে বের হয়ে চলে যাব এমন মূহূর্তে মা বললো, “মা! আমাকে কথা দে তুই আমার কথাগুলো রাখবি।” “অবশ্যই মা।” বলে আমি বের হয়েছি তাঁর রুম থেকে। মামার বাড়িতে রাত্রিযাপন করলাম। মামি বেশ আদর-আপ্যায়ন করেছেন।
খুব ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আজকের ভোরকে অনেক বেশি নিস্তব্ধ মনে হলো। যেন কোথায় কেউ একজন নিখোঁজ। আমার হঠাৎ করেই মা-র কথা মনে পড়লো। মা-কে দেখতে মন চাইলো। কিন্তু এতো ভোরে কিভাবে মামাকে বলি মার কাছে নিয়ে যেতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি মামাকে দেখলাম উদভ্রান্তের মতো। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আমি কিছুই আঁচ করতে পারছি না। আমি মামার সাথে গাড়ি করে হাসপাতালে পৌঁছতেই দেখি বেডে একটা নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে আছে। তাঁর দেহ সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। মামা আমাকে সেই নিথর দেহের প্রতি ইশারা করতেই আমি একটা অন্ধকার জগতে ডুবে গেলাম। সেই জগতে কোনো আলো নেই, কোনো আশা নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই আমি জ্ঞান হারালাম।
আজ মায়ের মৃত্যুর প্রায় ৪ বছর পূর্ণ হলো। মার মৃত্যুর পর বাবাও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। তাই তিনি চাচ্ছেন আমি যেন কোনোরকমে একটা স্থিতিশীল কিছু করি। আর বাংলাদেশে স্থিতিশীল পেশা বলতে ডাক্তারিকেই বুঝেন। আমার মুখে ক্রিকেটার হবার কথা শুনে একদিন রেগে তিনি বললেন, “ক্রিকেটাররা কেবল মানুষকে বিনোদন দেয়, আর ডাক্তাররা মানুষের সেবা করে। বুঝিস না কেন? ক্রিকেটার হলে অনেক ঝামেলা। তাছাড়া ডাক্তার আর নার্সের মেয়ে ক্রিকেটার হবে আমি এটা কোনোমতেই মেনে নিতে পারবো না।
না, না, না!” হ্যাঁ, আমি সেদিন তাঁকে বলতে পারি নি আমি ডাক্তার হতে চাই না। ক্রিকেটার হওয়ার প্রতি আগ্রহ যেন সেদিন স্বপ্ন থেকে ট্র্যাজেডির দিকে রূপ নিলো। কিন্তু তাই বলে আমি আশা ছেড়ে দেইনি। রুমানা ম্যাডামের প্রত্যক্ষ পথনির্দেশনায় আমি বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ টিমে সিলেক্ট হলাম। এবার বাবা কিছুটা হালকা হলেন। তিনি দোয়া করলেন, এবার যেন তাঁর মেয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে আসে।
আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত। টসে জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। ৫০ ওভারে ভারতের দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৮৯ রানে। বিরতির পর ব্যাটিং এ নামলো বাংলাদেশ। খেলা এখন সমাপ্তির দিকে। ৪৯ ওভারে গড়িয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটিং। ৪৯ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের দলীয় সংগ্রহ ২৭৬ রান। সর্বশেষ ওভার শুরু হয়েছে। প্রথম বলে ১ রান সংগ্রহ করেছে টিম বাংলাদেশ। দ্বিতীয় বল মাঠে গড়ালো। এ কি! অপ্রতিরোধ্য লেফট কাটারকে সামলাতে না পেরে উইকেট হারিয়েছেন নাজমা বেগম। বাংলাদেশী সমর্থকরা যেন শিরোপা ঘরে আনার সব আশা হারিয়ে ফেলেছেন। আমাকে মাঠে নামানো হলো। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচে এমন অনভিজ্ঞ ক্রিকেটার নামিয়ে ভুল করে থাকতে পারেন বলে মত দিয়েছেন অনেকে। মাঠে তৃতীয় বলটি গড়ালো। ডট বল। এবার যেন ক্ষীণ সম্ভাবনাও নিঃশেষ হয়ে গেল বলে। তখন মনে হলো আমার প্রতিজ্ঞার কথা যেটা আমি আমার মা-কে দিয়েছিলাম। মনে হলো, “কিছু ঘটনা যে সারাজীবনে একবারই ঘটে। যদি এখন না ঘটে তবে কবে ঘটবে?” সবাই যখন চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলো, তখনই ধারাভাষ্যকারের মুখে শোনা গেলো, “সিক্সার!!!” সবার মাঝে হঠাৎ করে সম্ভাবনার আলোকে উজ্জ্বল করলো। ধারাভাষ্যকার বলে উঠলো, “ফ্রি হিট এবং নীলা কবীরের আরেকটি ছক্কা!! বাংলাদেশ এবার বিশ্বের চ্যাম্পিয়ন! সবুজ ও লাল রঙ গায়ে ধারণ করা বাঘিনী করে দেখিয়েছে!! ১৮ কোটি মানুষ, কিন্তু এক পতাকা, এক জাতি, এক স্বপ্ন- এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। নীলা কবীর, এক ঐশ্বরিক মহিলা!!!”
আমাকে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ ঘোষণা করা হয়। যখন আমাকে প্রশ্ন করা হলো, “আপনি কীভাবে এই অসাধ্যকে সাধন করলেন?” আমি বললাম, “আমি শুধু প্রচেষ্টা করেছি, বাকিটা হয়েছে আপনাদের দোয়া, ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণার জন্যই। যারা আমাকে এই পর্যায়ে পৌঁছতে সাহায্য করেছেন, বিশেষত আমার মা, বাবা, রুমানা ম্যাডাম, আমার বন্ধুবান্ধব, কোচ, টিমম্যাট, সর্বোপরি আমার দেশবাসী- আমি সবার নিকট চিরকৃতজ্ঞ।” যখন দেশে ফিরলাম, তখন প্রধানমন্ত্রী নিজে এলেন সংবর্ধনা দিতে। রাজকীয়ভাবে বরণ করা হলো আমাদেরকে। আমি মনে মনে বললাম, “বাবা! দেখ, তোমার মেয়ে বিশ্বজয় করে বাড়ি ফিরেছে। তাঁর দেশকে সে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছে, তাঁর মাকে দেয়া কথা সে রাখতে পেরেছে।”
পানামনগর জাদুঘর ও মাস্টারমাইন্ড
শেখ ফাহিম ফয়সাল সৌরভ
নির্মল বাংলাদেশ
শহরের অভিজাত একজন মাস্টারমাইন্ড চোর যিনি অত্যন্ত মূল্যবান প্রাচীন শিল্পকর্ম চুরি করতেন। কেউ তার নাম জানেনা, কেননা তার নিজের জন্য রয়েছে কমপক্ষে পঞ্চাশটির বেশি পাসপোর্ট ও আইডি কার্ড। এই চুরির নিখুঁতি এবং জটিলতা রাতিকার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিল, যা তাকে আরও গভীরে তদন্ত করতে বাধ্য করেছিল।
নির্ঘুম ঢাকা শহর, তার মধ্যে রাতিকা, একজন অবিচল সাংবাদিক, এবং অমিত, একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। তাদেরকে একটি জটিল রহস্য ঘিরে রেখেছে। যদিও তাদের নিজেদের মধ্যে গোপনীয়তা ও পৃথক অনুসন্ধান তথ্য কখনোই শেয়ার হয় না, তারপরও তারা একে অপরকে এই রহস্যের সমাধানে চিনে ফেলে।
অমিত, তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং সূক্ষ্ম মনোযোগের জন্য পরিচিত, একই মামলায় নিযুক্ত হন। তার উপরিস্থ অধিকারীদের এবং মিডিয়ার বাড়তি চাপের পরও, চোরটি সর্বদা এক ধাপ আগে বিদ্যমান ছিল, যা অমিতকে পাগল করে দিচ্ছিল।
আজ একটি শিল্প প্রদর্শনীতে রয়েছে শেগুনবাগিচা শিল্পকলা একাডেমীতে, যা চোরের পরবর্তী লক্ষ্য এবং এবারের খবর প্রায় শতভাগ নিশ্চিত।
রাতিকা তার দল নিয়ে আগে থেকেই এই প্রদর্শনীর টিকিট কেটে ভিতরে যায় দর্শনার্থী হিসেবে। এদিকে গোয়েন্দা দল নিয়ে অমিতও একই যায়গায়। সেখানেই গোয়েন্দাদের চোখে পড়ে যায় রাতিকা ও তার দল। অমিত নিজে যেয়ে রাতিকা কে বলল, “এখানে আপনি ও আপনার সাথে যারা এসেছেন তারা কাকে খুঁজছেন আমরা জানি।”
রাতিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
-“আমি অমিত, এই মিশনে গোয়েন্দা বিভাগের লিড দিচ্ছি।”
– “আচ্ছা। আপনার নাম শুনেছি, কখনো দেখিনি। এভাবে দেখা হবে ভাবিনি। আমি রাতিকা। সংবাদকর্মী, নিউজ আলফা।”
– সাসপেক্ট কি এসেছে নাকি আসবে। কি মনে হয় আপনার?
রাতিকা উত্তর দেবার আগেই প্রদর্শনির লাইট বন্ধ হয়ে গেলো, অন্ধকার হয়ে গেলো রুম। চারিদিকে হট্টগোল। এবারো পালিয়ে গেলো মাস্টারমাইন্ড। কিন্তু অবাক করার বিষয়, এতো কিছু চুরি করার থাকলেও সে শুধু একটি ছবি নিয়েছে।
যখন তারা মামলাটির আরও গভীরে গেল, তারা আবিষ্কার করে চুরি করা শিল্পকর্মগুলি কেবল মূল্যবান ছিল না; তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল। এবার তারা আগে চুরি যাওয়া সব কিছু দেখে বুঝতে পারে সবকিছুই একটি ঐতিহ্যবাহী শহর পানামানগর এর সাথে সংযুক্ত ছিল, যা বিশ্বাস করা হয় যে শত বছর আগে এই শহর এই অঞ্চলের ব্যবসার মূল ছিল। যেখানে ছিল সকল ধনাঢ্য পরিবার এর বসবাস ও জমিদারগন।
রাতিকা ও অমিত যা শুরুতে কেউই ভাবেনি তার থেকে বেশি ঝুঁকি ছিল এই কাজে। তারা একজন সাধারণ চোরের সাথে মোকাবিলা করছিল না বরং কেউ যিনি ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতেন এবং প্রাচীন শহরের সম্পদ উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল। তদন্ত তাদেরকে একটি ধাঁধার মধ্যে নিয়ে গেল, কেনই বা এই চুরি।
পরদিন দুপুর ১২ টার দিকে অমিতের ফোন বেজে উঠে। তখন সে এটা নিয়েই চিন্তা করছিল এমন সময় ফোন ধরতেই-
– হ্যালো, স্যার। রমনা পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি। আপনার নামে একটি বাক্স কেউ একজন আমাদের স্টেশনের সামনে রেখে গেছে। অনেক বড়। ফ্রিজ মনে হয়।
– কি বলছো? নাম চেক করেছ?
– জ্বি স্যার। আপনার নাম আর ফোন নম্বর দেয়া। আর কিছু নাই।
গোয়েন্দা হওয়াতে এরকম বেনামি চিঠি, হুমকি সে প্রায়ই পায়। কিন্তু এভাবে পুলিশ স্টেশনে ফ্রিজ এর মতো কিছু পাওয়া টা সে কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না। কি কারনে যেন তার রাতিকার কথা মনে পড়লো এবং তাকে ফোন করলো। রাতিকা ফোন ধরছে না। দ্রুত সে রওনা দিলো পুলিশ স্টেশনে।
অনেকটা ভয় ও চিন্তায় দেখে পুলিশ স্টেশনেও বেশ থমথমে পরিস্থিতি। বাক্স খোলার সিদ্ধান্ত হলো, বোম্ব স্কোয়াড ইতোমধ্যে সবুজ সংকেত দিয়েছে। বাক্স থেকে বের হয়ে আসলো বিশাল এক ফ্রিজ, ডাবল ডোর নতুন ফ্রিজ। সবাই কানাকানি করছে। এরই মধ্যে ফ্রিজ এর দরজা খুলতে এগিয়ে আসলো অমিত।
ফ্রিজ খোলা মাত্র সবার চোখ উপরে উঠে যাবার মত অবস্থা। এতদিন এর সমস্ত জিনিজ যা যা চুরি হয়েছে সব কিছু এখানে। পিছন থেকে হঠাৎ রাতিকার আওয়াজ, “আরে সবকিছুই তো এখানে।”
রাতিকার শব্দ শুনেই অমিত তার দিকে ঘুরে নিজের অজান্তেই স্বস্তি ফিরে পেলো যেনো কোনো এক অজানা চিন্তা থেকে সে মুক্তি পেলো।
– হ্যাঁ, তুমি কোথায় ছিলে। ফোন দিচ্ছিলাম।
– আমি খবর পেলাম পুলিশ স্টেশনে কিছু পাওয়া গেছে, আর তোমার ফোন দেখে বুঝে গিয়েছিলাম তুমি এখানেই।
– কিন্তু কিছু বুঝছি না ফ্রিজে কেনো সেই মাস্টারমাইন্ড রেখে গেলো এগুলো?
রাতিকা নিজের ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করে বললো, “আমার বাসার সামনে এই চিঠি রেখে কেউ চলে গিয়েছে। এখানে লেখা আছে।”
তারা দুজনেই খুবই অবাক হয়ে একত্রে বুঝতে পারলো মাস্টারমাইন্ড কে তারা না জানলেও , এই তদন্ত ও তার পিছনে যারা আছে তাদের প্রতিটি খবর সেই মাস্টারমাইন্ড রাখে।
অবশেষে চিঠিতে লেখা নির্দেশ অনুযায়ী এই সমস্ত চুরি করা জিনিস ও আরো কিছু পানামানগর সম্পর্কিত তথ্য, ভাস্কর্য, চিত্র, শিল্পকর্ম, ইত্যাদি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল এক জাদুঘর। গোপন থেকে গেলো সেই মাস্টারমাইন্ড।